সায়ীদ আবুবকর
স্প্যানিশ ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯২৭-২০১৪)। আধুনিক উপন্যাসকে সমগ্র বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে যে কয়জন হাতেগোনা লেখক বিশেষ ভূমিকা রাখেন তাদের একজন এই মার্কেজ। গ্যাবো নামে খ্যাত এ নোবেল লরেট ১৯২৭ সালের ৬ মার্চ কলম্বিয়ার এরাক্যাটাকায় জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৭ এপ্রিল ২০১৪ মেক্সিক্যান সিটির
একটি হাসপাতালে।
লিফ স্টর্ম (পাতার ঝড়) তার প্রথম ঊপন্যাসিকা যা প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। কিন্তু তাকে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত করে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তার কিংবদন্তিতুল্য উপন্যাস সিয়েন অ্যানোস দ্য সোলেদাদ (ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড, বাংলায় শত বছরের নীরবতা)। আঠারো মাস প্রতিদিন একটানা আট থেকে দশ ঘণ্টা লিখে তিনি উপন্যাসটি সমাপ্ত করেন, যা তার জন্য বয়ে আনে ১৯৮২ সালের নোবেল প্রাইজ। ইন ইভিল আওয়ার (১৯৬২), দ্য অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক (১৯৭৫), ক্রনিকল অব এ্যা ডেথ ফোরটোল্ড (১৯৮১), লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা (১৯৮৫), দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ (১৯৮৯), অব লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস (১৯৯৪), মেমোরিজ অব মাই মেলানকুলি হোরস (২০০৪) তার অন্যান্য বিখ্যাত উপন্যাস। তার প্রকাশিত ছোটগল্পের সংকলন : আইস অব এ্যা ব্লু ডগ (১৯৪৭), বিগ মামাস ফিউনেরাল (১৯৬২), দি ইনক্রেডিবল অ্যান্ড স্যাড টেইল অব ইনোসেন্ট ডরেন্ডিরা অ্যান্ড হার হার্টলেস গ্র্যান্ডমাদার (১৯৭৮), কালেক্টেড স্টোরিস (১৯৮৪) ও স্ট্রেনজ পিলগ্রিমস (১৯৯৩)।
তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি সিয়েন অ্যানোস দ্য সোলেদাদ। দ্য টাইমস-এর সাহিত্য ক্রোড়পত্র সিয়েন অ্যানোস দা সোলেদাদকে বর্ণনা করেছে একটি কমিক মাস্টারপিস এবং ল্যাটিন আমেরিকার সর্বকালের সেরা উপন্যাসের একটি হিসেবে। এটি ১৯৬৯ সালে ফ্রান্সের প্রিক্স দু মেল্যুযার লিভরে ইট্রাঙ্গার এবং একই বছরে ইতালির প্রেমিও চিয়ানসিয়ানো পুরস্কার অর্জন করে। এটি ২৩টি দেশে প্রকাশিত হয়েছে এবং স্প্যানিশ ভাষায় ২১টি মুদ্রণে মোট দশ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। অনূদিত হয়েছে ১৮টি ভাষায়।
গার্সিয়া যে জগতের কল্পনা করেন তার শিকড়বাকড় বাস্তব জগতের গভীরে গ্রথিত। কিন্তু এটা বড়ই প্রতারণাময় কারণ তার বাস্তবতা হলো প্রায়ই জাদু-বাস্তবতা। তার প্রথম উপন্যাস লিফ স্টর্মে আমরা দেখতে পাই, বৃদ্ধ ডাক্তার সবাইকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে মেইড-সার্ভেন্টকে এ কথা বলে, ‘দ্যাখো, মিস, দ্রুত ছোট ঘাস সেদ্ধ করা শুরু করো এবং তা আমার কাছে নিয়ে আসো স্যুপের মতো করে।’ সার্ভেন্ট বলল, ‘কোন ধরনের ঘাস, ডাক্তার?’ ডাক্তার বলল, ‘সাধারণ ঘাস, ম্যাম, গাধারা সাধারণত যা খেয়ে থাকে।’ এটাই কি জাদু-বাস্তবতা? গার্সিয়ার কাছে অবশ্য তা নয়। গার্সিয়া এসব বিষয়ে খুব কমই বিস্মিত হন। তিনি বলেন, ‘মেক্সিকোর রাস্তায় রাস্তায় জাদু-বাস্তবতা ছুটে বেড়ায়। জাদু-বাস্তবতা এসেছে মূলত ল্যাটিন আমেরিকা থেকে।’
কলম্বিয়ান শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সম্পর্কে একবার এক সাংবাদিক গার্সিয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে চান। ওই এলাকার একটি স্কুলে এ ঘটনা ঘটে। সকাল ১০টার দিকে দু’জন লোক ট্রাকে চড়ে এসে বলে, ‘আমরা ফার্নিচারের জন্য এসেছি।’ কেউ তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানত না। কিন্তু হেডমাস্টার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে।’ ট্রাকে ফার্নিচার বোঝাই করা হলো এবং ট্রাকটি চলে গেল। অনেক পরে টের পাওয়া গেল ট্রাকের লোক দুটো চোর ছিল। গার্সিয়া হেসে বলে উঠলেন, ‘স্বাভাবিক ব্যাপার’। তিনি বলেন, ‘একবার বার্সেলোনায় আমি এবং আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। আমি দরোজা খুলে দিলাম। একজন লোক আমাকে বলল, ‘আমি আইরনিং কর্ড ঠিক করার জন্য এসেছিলাম।’ আমার স্ত্রী বিছানায় শুয়ে থেকেই বলল, ‘আমাদের আইরনের কোনো সমস্যা নেই।’ লোকটা বলল, ‘এটা কি দুই নম্বর এপার্টমেন্ট?’ আমি বললাম, ‘না। ওপরে’। পরে আমার স্ত্রী আইরন করতে গেল এবং এর কর্ড পুড়ে গেল। আমরা জানার আগেই লোকটা এসেছিল এটা ঠিক করে দেয়ার জন্য। এ ধরনের ঘটনা সব সময়ই ঘটে থাকে। এবং এ ধরনের ঘটনাই মার্কেজকে ঠেলে দেয় তার উপন্যাসে জাদু-বাস্তবতার তাজমহল নির্মাণ করার দিকে, যা একই সাথে সুন্দর হয়, বিশ্বাসযোগ্যও হয়।
গার্সিয়ার প্রথম দিককার উপন্যাসগুলো মোটেই সফল ছিল না। ভার্গাস লিখেছেন, ‘তিনি ব্যর্থতার স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন যখন তিসি লিফ স্টর্ম লেখা শেষ করেন’। এরপর তিনি ভায়োলেন্স নিয়ে লেখা লা মালা হোরা (দ্য ইভিল আওয়ার) শেষ করেন। এটিও সফলতা পায় না। প্যারিসে এসব অসফল লেখার দিনগুলো ছিল গার্সিয়ার লেখক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বড়ই কষ্টের। একজন বিদেশী হিসেবে প্যারিসে তার জীবন ছিল দারিদ্র্যে ভরা; তার কোনো কাজের অনুমতি ছিল না, তিনি সেখানকার ভাষাও ঠিকমতো জানতেন না। গার্সিয়া বলেন, ‘আমি যদি তিনটি বছর এভাবে সেখানে না থাকতাম তাহলে সম্ভবত আমি কোনো লেখক হতে পারতাম না। এখানে আমি শিখেছিলাম যে, কেউ কখনো অনাহারে মারা যায় না এবং একজন মানুষ ব্রিজের নিচেও ঘুমাতে পারে। আমার স্ত্রী এবং আমি প্যারিস থেকে বার্সেলোনায় চলে এসেছিলাম। আমি সব সময় চাইতাম যেসব জিনিস খাই যা কখনো খাইনি, সেই ওয়াইন পান করি যা কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। এবং এগুলো আমি ঘৃণা করতাম। সত্যি বলতে কী, আমি প্যারিসকে ঘৃণা করি।’ ভেনিজুয়েলায় অবস্থানকালীন গার্সিয়ার লেখক জীবন ছিল স্থিতিশীল কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। কিউবার বিপ্লব তাকে উঠিয়ে দেয়। তিনি প্রেনসা ল্যাটিনার বোগোটা অফিস খোলেন, পরে হাভানায় চলে যান এবং ১৯৬১ সালে নিউ ইয়র্কে সহকারী ব্যুরো চিফ হিসেবে যোগদান করেন।
এটা ছিল ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাস যখন মেক্সিকো সিটি থেকে গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে তার সিয়েন অ্যানোস বইয়ের প্রথম পরিচ্ছদ তিনি কল্পনা করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন আর্জেন্টিনিয়ান লেখককে জানান যে, ওই সময় তার যদি কোনো টেপ রেকর্ডার থাকত তাহলে তিনি পুরো চ্যাপ্টারটাই ডিক্টেট করে দিতেন। ওই অবস্থায় তিনি বাড়িতে ফিরে যান এবং তার স্ত্রীকে বলেন, ‘আমাকে বিরক্ত করবে না, বিশেষ করে টাকা-পয়সা নিয়ে’। এই বলে তিনি তার লেখার ডেস্কে চলে গেলেন যাকে তিনি বলেছেন মাফিয়ার গুহা। এটি মেক্সিকো সিটির ৬ কলা ডা লা লোমার একটি বাড়ি। এবং প্রতিদিন আট থেকে দশ ঘণ্টা করে পরিশ্রম করে আঠারো মাস পর তার উপন্যাসটি লেখা শেষ করেন।
মার্কেজ সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি জানি না আমার স্ত্রী এ সময় কী কাজ করত। আমি তাকে কখনোই এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করিনি। কিন্তু আমরা এমনভাবে বাস করতাম যেন আমাদের অনেক টাকা আছে। আমি যেদিন লেখাটি শেষ করেছিলাম, আমার স্ত্রী আমাকে বলল, ‘আসলেই কি তুমি লেখাটা শেষ করতে পেরেছ? আমরা এ পর্যন্ত বারো হাজার ডলার ধার করেছি।’ সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে দেড় বছর ধরে ধার নিয়ে এসেছে।’ তার স্ত্রী যেহেতু একজন ভালো ক্রেতা ছিল, গোশতওয়ালা তাকে অফার করেছিল যে তিনি প্রতিদিন টাকা না দিয়ে মাস শেষেও দিতে পারেন। তার স্ত্রী প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু যখন হাতটান শুরু হলো সে মাস চুক্তিতে রাজি হয়ে গেল। এ দিকে প্রতি মাসের বাসাভাড়া দেয়া যখন অসম্ভব হয়ে উঠল, সে বাড়িওয়ালাকে জানাল যে, সে ছয় মাস পর্যন্ত কোনো ভাড়া দিতে পারবে না। বাড়িওয়ালা বলল, ঠিক আছে। ফলে এসব নিয়ে তাদের কোনো বেগ পেতে হয়নি। গার্সিয়া বলেন, ‘আমার স্ত্রী আসলে অসাধারণ।’
প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের জাদু-বাস্তবতার সারনির্যাস হচ্ছে তার সিয়েন অ্যানোস দ্য সোলেদাদ উপন্যাসটি। ল্যাটিন আমেরিকার একটি ছোট্ট গ্রাম মাকোন্ডোর একটি পরিবারের সদস্যদের জীবনকাহিনী এটি, যা এক শ’ বছরের লোকজ ইতিহাস ধারণ করে আছে। এর মধ্যে আমরা দেখতে পাই ম্যাজিক কার্পেট উড়ে যাচ্ছে, ভূত এসে আছর করছে গ্রামের ওপর। মার্কেজের ওপর আমি যে লেখকের সবচেয়ে বেশি প্রভাব ল করি তিনি হলেন শেক্সপিয়র। শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি মানেই হলো ভূতপ্রেতের ট্র্যাজেডি। সর্বকালের সেরা নাটকের একটি তার হ্যামলেট। হ্যামলেট শুরুই হয়েছে ভূত দিয়ে এবং ভূতের নির্দেশনাতেই চলেছে হ্যামলেটের পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ-অভিযান। মার্কেজের উপন্যাস মানেও ভৌতিক-অতিলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার। সিয়েন অ্যানোস দ্য সোলেদাদ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু কয়েকটি : জাদু-বাস্তবতা, ইনচেস্ট, ধর্ম, সভ্যতা, মহামারী, আধুনিকতা ও নারীদের যৌনজীবন। জোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, আমারান্তা, উরসুলা, অরেলিয়ানো, জোসে আর্কাদিও সেগুন্দো প্রভৃতি চরিত্রের মধ্য দিয়ে এমন এক জাদুর জগৎ নির্মাণ করেছেন মার্কেজ তার এ উপন্যাসে যে, একবার এখানে কেউ প্রবেশ করলে মুড়ো না দেখে সে বের হতে পারবে না। তার উপন্যাসের মনস্তাত্ত্বিক গতিপ্রবাহ আধুনিক মানুষকে আন্দোলিত না করে পারে না। তবে তার উপন্যাসের মাত্রাতিরিক্ত যৌনতা অনেকটাই আরোপিত এবং লেখকের মনোবৈকল্যের বহিঃপ্রকাশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
No comments:
Post a Comment