সাধারণত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা জানেন সময় কত বেশি মূল্যবান। একটি প্রবাদ আছে ‘সময় হলো সোনার মতো দামি’। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করেন। আর ইসলামে সময় স্বর্ণ কিংবা বিশ্বের যেকোনো মূল্যবান বস্তুর চেয়ে বেশি দামি। সময়ের মূল্য কী, ইসলাম শুধু তা-ই শেখায় না। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম মানবজাতিকে বিশেষভাবে শেখায়, সময়ের মূল্য দিতে হবে কিভাবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতালা ও তার রাসূল মুহাম্মদ সা: খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন সময়ের মূল্য, আমরা
অবশ্যই সময় নষ্ট করব না এবং কিভাবে আমরা সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারি এসব সম্পর্কে। আল্লাহ ও রাসূল সা: বলেছেন আমরা ঈমান বৃদ্ধি করে সাফল্য অর্জনের জন্য প্রজ্ঞাপূর্ণ উপায়ে সময়কে কাজে লাগাতে পারি। আর এই সাফল্য হলো বিশেষ করে পরকালের চিরন্তন সফলতা।
কুরআন ও সুন্নাহ, উভয়েই মুসলমানদের নির্দেশ দেয় সময়ের ব্যাপারে সচেতন হতে। আমাদের মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, এই পৃথিবীর জীবন অস্থায়ী ছাড়া কিছু নয়। আমরা জানি না কখন আমাদের মৃত্যুর সময় নির্ধারিত রয়েছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের অবশ্যই সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সাফল্যের প্রয়োজনেই আমরা কখনো সময়ের অপচয় বা অপব্যবহার করতে পারি না।
হজরত ইবনে আব্বাস রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, মানুষের জন্য দু’টি আশীর্বাদ রয়েছে, যা অনেকেই হারিয়ে ফেলে। এগুলো হলো ভালো কাজের জন্য স্বাস্থ্য ও সময়। (বুখারি শরীফ ৮/৪২১)
সত্যিই, যখন আমরা সময় নষ্ট করি, তখন আমরা মহান আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করি। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সময়কে অবশ্যই ব্যয় করতে হবে আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য পূরণের জন্য। তার অর্থ হচ্ছে, পুরো জীবনভর আল্লাহর ইবাদাত করা। আল্লাহতালা আল কুরআনে এটাকে খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করিনি (কেবল) আমার ইবাদাত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। আমি তাদের কাছ থেকে কোনো জীবিকা চাই না কিংবা বলি না যে, তারা আমাকের খাওয়ানো উচিত। নিশ্চয়ই আল্লাহতালাই তো জীবিকাদাতা, শক্তির আধার ও পরাক্রান্ত। (আল কুরআন, সূরা আয্ যারিয়াত, আয়াত ৫৬-৫৮)।
তিনি আরো বলছেন, অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার প্রশংসাগুলোকে মহিমান্বিত করুন এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। আর প্রতিপালকের ইবাদাত করুন, যে পর্যন্ত না আপনার কাছে নিশ্চিত কথা আসে। (আল কুরআন, সূরা হিজর, আয়াত ৯৮-৯৯)।
আমরা যা কিছুই কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক করি না কেন, তা-ই ইবাদাত। আর ইবাদাত অবশ্যই করতে হবে আন্তরিকতার সাথে; শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই। আমরা আমাদের সময় ব্যবহার করা উচিত কল্যাণকর কাজে। বিশেষত ওই সব কাজই আমাদের করা উচিত, যেগুলো আমাদেরকে আল্লাহতালার আরো ঘনিষ্ঠ করবে এবং অর্জন করবে তার করুণা ও ক্ষমা।
কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে আরো জানার মধ্য দিয়ে আমাদের সময়কে লাগাতে হবে কাজে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: আমাদের কী করার নির্দেশ দিয়েছেন, সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আমাদের থাকতে হবে অবশ্যই। একই সাথে, তাঁরা আমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকার জন্য কী কী করণীয়, তা-ও সঠিকভাবে জানতে হবে। এটা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক; যাতে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভ করতে পারি।
পরম মর্যাদাবান আল্লাহ এটাকে খুবই স্পষ্ট করে এভাবে বলেছেন ‘হে বিশ্ববাসীগণ! আল্লাহকে মেনে চল, আর মান্য কর বাণীবাহককে (মুহাম্মদ) এবং তোমাদের কাজকর্ম বৃথা যেতে দিয়ো না।’ (আল কুরআন, সূরা মুহাম্মদ, আয়াত- ৩৩)
ওপরে উল্লিখিত ঐশী নির্দেশের স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে আমাদের নিজেদের অবশ্যই প্রশ্ন করা উচিত : আমরা কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: কে মেনে চলছি? সঠিক ঈমানের সন্ধান লাভ, সৎ কাজ করা, সত্যের নির্দেশদান কিংবা দীনের দাওয়াতের জন্য এবং ধৈর্যশীল ও অবিচল হওয়ার প্রয়োজনে আল কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে জানতে আমরা সময় দিয়েছি কতটুকু? সময় পার হতে থাকার সাথে সাথে আমরা কি নিশ্চিত যে, মহান আল্লাহর ইবাদাত ও সন্তোষের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে সময়কে নিয়োজিত করছি? আমরা কি কুরআন শরিফের এই আয়াতগুলো থেকে পথনির্দেশনা গ্রহণ করছি, যেগুলো আমাদের জন্য জ্ঞানের উৎস?
‘কালের কসম, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে, তারা ছাড়া যারা ঈমানদার, সৎ কর্মশীল, পরস্পরকে সত্যনিষ্ঠার নির্দেশ প্রদানকারী এবং ধৈর্য ধারণকারী ও অবিচল। (আল কুরআন, সূরা আসর, আয়াত ১-৩)।
কুরআনের ওপরে বর্ণিত নির্দেশ মোতাবেক, সময়ের মূল্যকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের নিজেদের সুশৃঙ্খল করে তুলতে হবে। সৎ কাজে আমাদের অবশ্যই দ্রুত গতি থাকতে হবে। এতে আমাদের ঈমান বাড়বে। ফলে আল্লাহতালার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা অর্জনের যোগ্যতা আমরা পারব হাসিল করতে। আমাদের মনে রাখা উচিত, শেষ বিচারের দিনে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে আমরা আমাদের জীবন, সম্পদ ও জ্ঞান কিভাবে ব্যয় করেছি, সে ব্যাপারে। অন্য কথায়, আল্লাহ যা আমাদের দিয়েছেন, তার প্রতিটি জিনিস আমরা কীভাবে খরচ করলাম, সে সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন করা হবে। নিম্নের হাদিস থেকে তা জানা যায়।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা: বলেছেন ‘মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন দিবসে মানুষকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তার জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, কিভাবে তা ব্যয় হয়েছে? তার যৌবনকাল সম্পর্কে বলা হবে, কেমন করে সে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে? সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন হবে, এই সম্পদ সে অর্জন করল কোত্থেকে? আর কিভাবেই বা তা খরচ করেছে? তার যে জ্ঞান ছিল, তা দিয়ে সে কী করেছে?’
আবু কারযাহ নাদ্লাহ ইবনে উবাইদ আল আসলামি বর্ণনা করেছেন রাসূল সা: বলেছেন, ‘শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর বান্দাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে, যে পর্যন্ত না তাকে প্রশ্ন করা হয় : তার বয়স সম্পর্কে আর কিভাবে তা ব্যয় করেছে এবং তার জ্ঞান সম্পর্কে, সে তা ব্যবহার করেছে কিভাবে; তার সম্পদ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে, কোত্থেকে এটা অর্জন করল এবং কোন কোন কাজে তা ব্যয় হয়েছে; আর তার দেহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে, কিভাবে এটা ব্যবহার করা হয়েছে।’
যদি আমরা নিজেদের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করি, তাহলে বলতে হয়, আমরা কি সর্বশক্তির অধিকারী আল্লাহতালাকে খুশি করার জন্য আমদের সময়কে বুদ্ধিমত্তাসহকারে ব্যয় করে আসছি? আমরা কি কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে আমাদের জীবনটা ব্যয় করছি? আমরা কি বাস্তব জীবনে ইসলামের অনুসারী? আমাদের ক’জনই বা মুমিন বা ঈমানদার কিংবা মুত্তাকি, অর্থাৎ আল্লাহর ভয় পোষণকারী? আল কুরআন ও সুন্নাহর কতটুকু আমরা জানি? যা আমরা জানি, তা কি কাজে পরিণত করি এবং সে জ্ঞান অন্যদেরকেও দিই; অন্তত আমাদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কি সে জ্ঞান বিতরণ করি? যা সত্য ও ন্যায়, অন্যদের আমরা কি কখনো তার নির্দেশ দিয়েছি এবং অসৎ কাজ করতে তাদের কি নিষেধ করেছি?
সফল হতে হলে, আমাদের সময়কে আমরা যেন প্রজ্ঞার সাথে কাজে লাগাই। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, এমন সৎ কাজের পরিকল্পনার মাধ্যমে তা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই ইসলাম সম্পর্কে জেনে সময় ব্যয় করতে হবে। সে জ্ঞান হবে কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক।
ড. নর্লেইন ডিনডাং মাবাবায়া
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
No comments:
Post a Comment