নোবেল বিজয়ী অরহ্যান পামুক : ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সেতুবন্ধ |
২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকেই তুর্কি কথাশিল্পী অরহ্যান পামুক দেশে-বিদেশে বিপুল আলোচিত ও সমালোচিত ছিলেন, তার উপন্যাসের বিষয় ও গঠনশৈলী, তার কিছু কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান এবং বক্তব্যের কারণে। কিন্তু এ কথা সবাই সমস্বরে স্বীকার না করে পারেননি যে, পামুক যথার্থই একজন উঁচুস্তরের শিল্পী, যিনি তার পুরো জীবন, তার সব মেধা ও শ্রম, স্রেফ লেখালেখির জন্যই উৎসর্গ করেছেন। পূর্ব ও পশ্চিম এবং অন্যভাবে, ইসলাম ও পাশ্চাত্য এ দু’টি পরে মধ্যকার সম্পর্ক সূত্র আবিষ্কার এবং উভয়ের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিন্যাস দাবি করে তিনি বিশেষ আলোচিত এবং বিতর্কিত হয়েছেন। সুইডিশ একাডেমি তার পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে বলেছে, পামুক বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যকার সংঘর্ষ ও সংমিশ্রণের নতুন প্রতীকগুলোকে আবিষ্কার করেছেন। তিনি তার উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ইসলাম ও পাশ্চাত্য, মৌলবাদ ও ধর্মনিরপেতাবাদ, ওসমানীয় অতীত ও ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় উপস্থিতি এ রকম বহুকাল বিরাজমান বিপরীত মেরুর মাঝখানে সাহিত্যিক সেতু নির্মাণে অবদান রেখেছেন।
পামুকের জন্ম তুরস্কের এক সময়ের রাজধানী ঐতিহ্যসমৃদ্ধ, সুপ্রাচীন বন্দরনগরী ইস্তাম্বুলে, ১৯৫২ সালের ৭ জুন একটি উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবারে। তাকে ইস্তাম্বুলের অ্যামেরিকান রবার্ট কলেজে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেখানে নগরীর সুবিধাপ্রাপ্ত ধনিক শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা পশ্চিমা ধাঁচের ধর্মনিরপে শিালাভ করত। এই কলেজ থেকেই তিনি গ্র্যাজুয়েশন নেন। চিত্রশিল্পের প্রতি ছিল তার আবাল্য আগ্রহ। ১৯৭০ সালে তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হন স্থাপত্যবিদ্যা পড়ার জন্য, কিন্তু তিন বছর পড়ার পর কলেজ ত্যাগ করেন। সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে ভর্তি হন ইস্তাম্বুল ইউনিভারসিটিতে সাংবাদিকতা বিভাগে। ১৯৭৭ সালে তিনি সাংবাদিকতায় ডিগ্রি লাভ করেন কিন্তু কখনো সাংবাদিকতা করেননি। তারপর সিদ্ধান্ত নেন লেখক হবেন। ২৩ বছর বয়সে পামুক পুরোপুরি লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। এখন তিনি তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিদেশেও ব্যাপক পঠিত ও আলোচিত লেখক। এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৫টি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে।
পামুকের প্রথম উপন্যাস কেভদেত বে অ্যান্ড হিজ সন্স প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। এটি লিখে তিনি অরহ্যান কামাল নভেল প্রাইজ ও মিল্লিয়েত লিটারারি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তারপর একে একে বের হতে থাকে দ্য সাইলেন্ট হাউস (১৯৮৩), দ্য হোয়াইট ক্যাসল (১৯৮৫, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯১), দ্য ব্ল্যাক বুক (১৯৯০, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৪) এবং দ্য নিউ লাইফ (১৯৯৪, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৭)। পামুক তার দ্য সাইলেন্ট হাউসের জন্য দেশের মাদারলি নভেল প্রাইজ ও ফ্রান্সের প্রিক্স দ্য লা দেকুভার্তি ইউরোপেনি এবং দ্য ব্ল্যাক বুকের জন্য প্রিক্স ফ্রান্স কালচার পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইমপ্যাক ডাবলিন লিটারারি অ্যাওয়ার্ড, ফ্রেঞ্চ প্রিক্স দু মিলিয়্যার লিভ্র অ্যাট্র্যাঞ্জার এবং ইতালির গ্রিঞ্জানি কাভুর পুরস্কার লাভ করেন তার বিখ্যাত উপন্যাস মাই নেম ইজ রেড (১৯৯৮, ইংরেজি অনুবাদ ২০০১) লিখে। এ উপন্যাসে ষষ্ঠদশ শতাব্দীর ইস্তাম্বুলে সংঘটিত একটি হত্যারহস্য বর্ণিত হয়েছে বহু কথকের বয়ানে। এ উপন্যাসে মূল যে কথা বলা হয়েছে তা হলো প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দ্বন্দ্বের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট, দ্বৈত সত্তার অস্তিত্ব, সৌন্দর্য ও মৌলিকত্বের মান এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের উদ্বেগ। স্নো প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে (ইংরেজি অনুবাদ ২০০৪ সালে)। এতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংস্কারবাদের ওপর আলোকপাত করা হয়। এটাই তার প্রথম উপন্যাস যেখানে সমকালীন তুরস্কের রাজনৈতিক চরমপন্থার বিরোধিতা করা হয়েছে এবং এটা তাকে দেশের ভেতরে বিতর্কিত করলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই বইয়ের জন্য তিনি লা প্রিক্স মেডিটেরানি অ্যাট্র্যাঞ্জার এবং ফ্রান্সের প্রিক্স মেডিসিস পুরস্কার লাভ করেন। পামুকের সাম্প্রতিক বই হচ্ছে ইস্তাম্বুল : মেমোরিজ অ্যান্ড দ্য সিটি (২০০৩, ইংরেজি অনুবাদ ২০০৫)। এটা তার নিজেরই দ্বৈত ছবি শৈশব ও যৌবনের এবং তার জন্মস্থানের। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে বের হয় তার প্রবন্ধ সঙ্কলন আদার কালারস। ২০০৫ সালে তাকে জার্মান বুক ট্রেড’স পিস প্রাইজ প্রদান করা হয়। ২০০৬ সালে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি তাকে ডিস্টিঙ্গুইশ্ড হিউম্যানিস্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। একই বছর তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৭ সালের মে মাসে জার্মানির ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব বার্লিন এবং ডিসেম্বরে অ্যামেরিকার জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ওসমানীয় শাসনামলে তুরস্ক কর্তৃক আর্মেনীয়দের ওপর গণহত্যা সংঘটিত করার অভিযোগ সম্পর্কে তার একটি মন্তব্যকে দেশের স্বার্থবিরোধী আখ্যায়িত করে ২০০৫ সালে তুরস্ক সরকার তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। পরে ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার লাভের পর তাকে এই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর আগে একবার তাকে ‘রাষ্ট্রীয় শিল্পী’র মর্যাদা গ্রহণের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তিনি বলেন, ‘লেখকদের জেলে দেয়, কেবল শক্তির জোরে কুর্দি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা ও সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আমি বছরের পর বছর রাষ্ট্রের সমালোচনা করে আসছি। এখন তারা কেন আমাকে পুরস্কৃত করতে চাচ্ছে আমি জানি না।’
তিনি বিয়ে করেন ১৯৮২ সালে, রুশ বংশোদ্ভূত ইতিহাসবিদ আইলিন তুরেজিনকে। স্ত্রীর গবেষণাকর্ম উপলে তার সাথে ১৯৮৫ সালে তিনি আমেরিকায় যান এবং সেখানে সে বছর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিন বছর কলাম্বিয়া ইউনিভারসিটিতে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে কাজ করেন। সেখানে থাকাকালে তিনি তার দ্য ব্ল্যাক বুকের বেশিরভাগ অংশ লেখেন। ১৯৯১ সালে তার একমাত্র সন্তান মেয়ে রুইয়ার জন্ম হয়। ২০০২ সালে স্ত্রীর সাথে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
সারা জীবন ইস্তাম্বুলেই বসবাস করেছেন পামুক। এই নগরী, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, তার প্রকৃতি-অবকাঠামো, সর্বোপরি তার অধিবাসী ও তাদের জীবনযাপন তার চিন্তা ও সাহিত্যকর্মের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থেকেছে সব সময়। তার আধুনিক ইস্তাম্বুল-চিন্তা জেমস জয়েসের ডাবলিন এবং গুন্টার গ্রাসের ড্যানজিগ-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
তার বইয়ের আয়তন বিশাল এবং বইগুলো বেশ কঠিন ও জটিল, তা ছাড়া তিনি অতি উচ্চমানের বোদ্ধা সাহিত্যিক, তা সত্ত্বেও অরহ্যান পামুক এখন বিশ্বজুড়ে বেস্টসেলিং লেখক। তবে তার সমালোচনারও অভাব নেই। তার দেশেই তার সমালোচনা বেশি এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেতাবাদী এই পরস্পরবিরোধী দু’টি পই তার সমালোচনায় মুখর। এই সমালোচনার কারণ তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ, পামুক পশ্চিমা উত্তর-আধুনিকতাবাদের নামে ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যা করেছেন। অন্য দিকে ধর্মনিরপেতাবাদীরা এদের মধ্যে গোঁড়া জাতীয়তাবাদী এবং পশ্চিমাকরণের অত্যুৎসাহী প্রচারকরাও রয়েছেন, তারা বিরক্ত এই জন্য যে, পামুক তাদের ও রাষ্ট্রের আদর্শ সমর্থন করেন না। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেন, ‘ওসমানীয় সাম্রাজ্যের জন্য আমি শোক করছি না। আমি পাশ্চাত্যকরণের সমর্থক। শাসক এলিট শ্রেণী ব্যুরোক্র্যাট এবং নব্য ধনিক সম্প্রদায় যে সঙ্কীর্ণ অর্থে পাশ্চাত্যকরণকে গ্রহণ করেছে আমি শুধু তার সমালোচনা করছি। তাদের সে আত্মবিশ্বাস নেই যা প্রয়োজন নিজেদের প্রতীক ও প্রথাদিসমৃদ্ধ জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্যে। তারা চেষ্টা করে না একটা ইস্তাম্বুল-সংস্কৃতি গড়ে তুলতে যা হবে পূর্ব ও পশ্চিমের জৈবিক সংগঠন, তারা স্রেফ প্রতীচ্য ও প্রাচ্যের জিনিসগুলোকে একত্রে রেখেছে। অবশ্য আমাদের একটা শক্তিশালী ওসমানীয় সংস্কৃতি ছিল, কিন্তু তা একটু একটু করে য়ে যাচ্ছে। তাদের যা কর্তব্য ছিল এবং যা তারা যথেষ্ট করতে পারেনি, তা হলো একটা শক্তিশালী স্থানীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যা হবে প্রাচ্যের অতীত এবং প্রতীচ্যের বর্তমানের মিশ্রণÑ অনুকরণ নয়।...পশ্চিমের দাসসুলভ অনুকরণ কিংবা অন্ধের মতো পুরনো মৃত ওসমানীয় সংস্কৃতির অনুকরণ, কোনোটাই সমাধান নয়।’ মূলত তার প্রকৃত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিশেষ কোনো দল বা আদর্শের অনুসারী নয়, তা এখানে সুস্পষ্ট হয়েছে। ২০০৫ সালে দ্য প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত এক সাাৎকারে তিনি আরো মূর্ত করে বলেন, ‘ধর্মনিরপেতাবাদীরা বিরক্ত, কারণ আমি বলেছি, তুরস্কে ধর্মনিরপে সংস্কারবাদী হওয়ার মানে হচ্ছে গণতন্ত্রী হওয়ার কথা ভুলে যাওয়া। ধর্মনিরপেতাবাদীদের শক্তির উৎস সেনাবাহিনী। এটা তুরস্কের গণতন্ত্র এবং সহনশীলতার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে। একবার যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সেনাবাহিনী এতটা সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে তখন জনগণ তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং সব সমস্যার সমাধানে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে। তখন জনগণ সাধারণত বলে দেশ ও অর্থনীতি বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে, সেনাবাহিনী এসে সব পরিষ্কার করুক। কিন্তু ঠিক যতটা পরিষ্কার তারা করে ততটাই ধ্বংস করে সহনশীলতার সংস্কৃতিকে। অসংখ্য সন্দেহভাজন নির্যাতনের শিকার হয়, হাজার হাজার মানুষকে জেলে ঢোকানো হয়। এটা নতুন সেনা অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করে দেয়। প্রত্যেক ১০ বছর পর একটা করে এ রকম নতুন ঘটনা ঘটে। সুতরাং এটার জন্য আমি ধর্মনিরপেতাবাদীদের সমালোচনা করি। আমি যে ইসলামপন্থীদের মানুষ হিসেবে চিত্রিত করি সেটাও তারা পছন্দ করে না। আর ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের বিরক্তির কারণ হলো, আমি এমন একজন ইসলামপন্থীর ছবিও আঁকি যার বিবাহ-পূর্ব যৌন অভিজ্ঞতা আছে। ব্যাপারটা এ রকমই সরল। ইসলামপন্থীরা আমাকে সব সময় সন্দেহ করে কারণ, আমি তাদের সাংস্কৃতিক বলয় থেকে আসিনি ও আমার ভাষা, মানসিকতা এমনকি অঙ্গভঙ্গি পর্যন্ত অনেক বেশি পাশ্চাত্যয়ী এবং সুবিধাভোগীদের মতো। তারা আমাকে তাদের লোক বলে মনে করতে পারে না। তারা জিজ্ঞেস করে, কী করে আমাদের সম্পর্কে সে লিখতে পারে? সে তো আমাদের সম্পর্কে জানে না। ...কিন্তু আমি বাড়াবাড়ি করতে চাই না। ...এটা ক্রমবর্ধমান উদারনৈতিক মানসিকতার লণ যে, তারা আমাকে এবং আমার বইকে গ্রহণ করেছে। অন্যরা, সাধারণত তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা, আর্মেনীয়দের কথা বললেই ঘাবড়ে যায়। তারা বলে যে, আমি আর্মেনিয়ার পে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছি যা একেবারেই অযৌক্তিক। আমাদের এ রকম একটা সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিও আছে।’ অন্য কিছু লোক পামুকের নিন্দা করেন স্রেফ এই বলে যে, তার বই খুব কঠিন এবং আত্মমুখী। এতসব সত্ত্বেও তার বইয়ের প্রকাশক ও পাঠকের অভাব হয়নি কখনো।
যারা ধারণা করেন তুরস্ক ইসলাম এবং ধর্মনিরপেতাবাদ, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে, পামুক তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘তুরস্কের যে দু’টি আত্মা আছে তা কোনো অসুখ নয়।’ তিনি ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার বিরোধী, কিন্তু এশিয়াকেও ছাড়তে নারাজ। ২০০৪ সালে বোস্টন গ্লোব ইন্টারভিউতে তিনি বলেন, ‘তুরস্কের সংস্কৃতির আত্মা দু’টি, তা যে সব সময় যুধ্যমান এমন নয়, বরং মিলনের পথ অনুসন্ধানে সচেষ্ট।’
ঔপন্যাসিক এবং অরহ্যান পামুকের উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদক মওরিন ফ্রিলি তার এক লেখায় পামুকের দৃষ্টিভঙ্গির একটি চমৎকার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘একটা দেশকে আধুনিকীকরণের সর্বোত্তম উপায় হলো’, তিনি (পামুক) বলেন, “সেখানে আগে থেকেই বিরাজমান ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়ানো। কামাল আতাতুর্কের প্রজাতন্ত্রে এটা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুরস্কে অনেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল কেউ সংস্কারবাদী, কেউ মৌলবাদী এবং কেউ কেউ খুব উদার। তারা লড়াই ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিল। এসব মতবিরোধপূর্ণ জায়গাগুলোয় সংস্কার বিকশিত হচ্ছিল। কিন্তু কামাল আতাতুর্ক সেগুলোকে বন্ধ করে দিলেন এ কথা বলে যে, তারা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ওসমানীয় বা তুর্কি ইসলামের সমন্বয়ের সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে গেল।’ তার জায়গায় সৃষ্টি হলো ‘শূন্যতা’, যা রূপ নিলো ‘ঐক্যবদ্ধ, একক রঙের মৌলবাদে’।
এমনকি বলশেভিকরাও পুরনো ঐতিহ্যের জায়গায় আনতে চেষ্টা করে নতুন মানবতাবাদী চেতনা। কামাল আতাতুর্ক এমনকি তা-ও করতে পারেননি। তিনি জনগণকে উৎসাহিত করেছেন ‘সব কিছু সৃষ্টি করতে, এমনকি আত্মাও’। সে জন্য ধর্মের কপালে মেরে দেয়া হলো পশ্চাৎপদের লেবেল। শিল্প ছিল পরবর্তী ভাবনা এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় রাজনৈতিকভাবে সন্দেহ পোষণ করে যে, নিজ দেশে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির অভাব সব ধরনের আরো আকর্ষণীয় সংস্কৃতি আমদানিকে সম্ভব করে। সংস্কার তখনই হয়, তিনি আমাকে বলেন, যখন নিজের ‘কেন্দ্রীয় কিছু থাকে, যখন একটা মূল বিষয় বা নীতি আলোচিত হয়।’ আপাতবিরোধী হলেও সত্যি এই যে, যে রাজনৈতিক শূন্যতার জন্য তার এত পরিতাপ, তা-ই তার শৈল্পিক দিকনির্দেশনার উৎস হয়েছে।
পামুক প্রথমে বাস্তববাদী ঐতিহ্যের অনুসরণে লিখতে শুরু করলেও পরে উত্তর-আধুনিক কৌশলকে আশ্রয় করেন। তার উপন্যাস সুফি গল্প এবং ঐতিহ্যবাহী ইসলামি কাহিনীর পরো ও প্রতীকী ব্যবহারে সমৃদ্ধ, আবার একই সাথে জনপ্রিয় সংস্কৃতির চকমকিও তাতে রয়েছে। তার নীতি হচ্ছে, অতীতকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের অংশ হওয়া যাবে না। আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের যথার্থ সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন জীবনবোধের উৎসার ঘটাতে চান। বিখ্যাত লেখক জন আপডাইক বলেছেন, ‘তার নিরাবেগ বুদ্ধিমত্তা এবং অন্তর্দৃষ্টির নিখুঁত নকশা প্রস্তরের মতো।’ তিনি এ-ও ল করেন যে, ‘তিনি একই সাথে জনপ্রিয় এবং আভাগার্দে লেখক।’ তাকে বিশ্ববিখ্যাত লেখক ফ্রান্জ কাফকা, হোর্হে লুই বোর্হেস, ইতালো কালভিনো এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোজের সাথে তুলনা করা হয়।
কেন লিখেন এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বলেন তা মজার শোনায়, কিন্তু তা তার নিজস্ব, অন্যের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তুলে ধরে। তিনি বলেন, ‘আমি লিখি, কারণ আমার লেখার সহজাত প্রয়োজন আছে। আমি লিখি, কারণ আমি অন্য লোকদের মতো সাধারণ কাজ করতে পারি না। আমি লিখি, কারণ আমি বই পড়তে চাই যে রকম বই আমি লিখি। আমি লিখি, কারণ আমি আপনাদের সবার ওপর, প্রত্যেকের ওপর, রাগান্বিত। আমি লিখি, কারণ আমি সারাদিন ঘরে বসে লিখতে ভালোবাসি। আমি লিখি, কারণ আমি বাস্তব জীবনকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবল এর অংশীদার হতে পারি। আমি লিখি, কারণ আমি চাই অন্যরা আমাদের সবাই, গোটা দুনিয়া, জানুক ইস্তাম্বুলে, তুরস্কে, কী ধরনের জীবন আমরা যাপন করি এবং অব্যাহতভাবে করতে চাই। ...সম্ভবত আমি লিখি, কারণ আমি বুঝার আশা করি কেন আমি আপনাদের ওপর এত বেশি বেশি রাগান্বিত, প্রত্যেকের ওপর এত বেশি বেশি ক্রুদ্ধ। ...আমি লিখি, কারণ সবার জীবনের সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধিকে শব্দে পরিণত করার উত্তেজনা এতে আছে। আমি গল্প বলার জন্য লিখি না, বরং গল্প নির্মাণ করার জন্য লিখি। আমি লিখি কারণ আমি পালিয়ে যেতে চাই সেই পূর্বাভাসদান থেকে যে, এমন একটা জায়গা আছে যেখানে অবশ্যই যেতে চাই কিন্তু ঠিক স্বপ্নে যেমন হয় আদৌ সেখানে যেতে পারি না। আমি লিখি কারণ আমি কখনোই সুখের ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমি লিখি সুখী হওয়ার জন্য।’
পামুক যেমন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী আদর্শের বিরোধী, তেমনি সাহিত্যের েেত্রও উদার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক। তিনি বলেন, ‘...তাৎপর্যবহ পরিবর্তনসমৃদ্ধ বিশ্ব তথ্যপ্রবাহের যুগে, সাহিত্য লেখকরা আর সেই লোক থাকছেন না, যারা শুধু নিজের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে উদ্দেশ্য করবেন, বরং তারা এখন সেই লোক যাদের ল্য হতে পারবে এবং অবিলম্বে ল্য বানাবেন বিশ্বজোড়া ‘সাহিত্যিক উপন্যাস’ পাঠকগোষ্ঠীকে। ...লেখকরা লিখেন তাদের আদর্শ পাঠকের জন্য, তাদের প্রিয়ভাজনদের জন্য, তাদের নিজেদের জন্য অথবা কারো জন্য না। এ সবই সত্যি। কিন্তু এটাও সত্যি যে, আজকের লেখকরা লেখেন তাদের জন্যও যারা তাদের বই পড়েন। এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, আজকের লেখকরা ক্রমেই তাদের নিজ জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য (যারা তাদের বই পড়ে না) লিখছেন কম, বেশি লিখছেন বিশ্বজুড়ে যারা পড়েন সেই সংখ্যালঘিষ্ঠ সাহিত্যিক পাঠকদের জন্য।’
অরহ্যান পামুক একজন যথার্থ বড় মাপের সাহিত্যিক। তার শিল্পভাবনা একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে। আমাদের সাহিত্যসেবীদের জন্য তা নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উৎস হতে পারে। সে কারণে তো বটেই, অন্য আরেকটি কারণেও তিনি আমাদের বিশেষ আকর্ষণের উৎস। সেটি স্রেফ এই নয় যে, তিনি একজন মুসলিম এবং নাগিব মাহফুজের পর তিনি দ্বিতীয় মুসলিম সাহিত্যিক, যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন বরং সেটি এই যে, তিনি যে পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্বমুখর সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাতাবরণে বেড়ে উঠেছেন তার সাথে আমাদের পরিস্থিতির অনেক মিল রয়েছে। তার দেশের মতো আমাদের দেশেও ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেতাবাদী, দু’টি প রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে এবং তুরস্কের মতো এখানেও তারা বেশ নিরাপস এবং কখনো কখনো চরমপন্থার অনুসারী, অনেক সময় ‘ফরজ’ রেখে ‘নফল’ নিয়ে টানাটানিতে লিপ্ত। এ অবস্থায় আমাদের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে এবং জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে, অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে জাতির অনৈক্য এতটাই তীব্রতর যে, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও আজ হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থায় ধর্মকে পরিহার না করে তাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা এবং একই সাথে আধুনিকতাকে আত্মস্থ করার যে নীতির কথা অরহ্যান পামুক সাহিত্যিক প্রতীকের আশ্রয়ে, কখনো বা সরাসরি বক্তব্য আকারে বলতে চেয়েছেন, তা আমাদের চিন্তার খোরাক দিতে পারে এবং আমাদের অবস্থানের পুনর্বিবেচনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
নাজিব ওয়াদুদ
No comments:
Post a Comment