Today's Quote

Only a life lived for others, is a life worthwhile
-Albert Einstein

Saturday, 23 August 2014

১ অক্টোবর প্রবীণ দিবস – ভালো থাকুন আপনারা



প্রবীণদের ভালো রাখা আমাদের সবারই দায়িত্ব। জরা বা বার্ধক্য জীবনের এক চরম সত্য। শৈশবের সোনালি সকাল শেষ করে তারুণ্য আর যৌবনের রোদেলা দুপুর পাড়ি দিয়ে মাঝ বয়সের ব্যস্ত বিকেলটাও যখন চলে যায়, তখনই যেন গোধূলিবেলা হয়ে আসে বার্ধক্য। এই সময়টা আসলে
মানবজীবনের শেষ অধ্যায়। নেহাত অকালমৃত্যু না হলে এই স্তরটিতে পদার্পণ করতেই হবে। বার্ধক্যকে এড়িয়ে চির তারুণ্যের সোনার হরিণ ধরার চেষ্টা মানব ইতিহাসজুড়েই হয়েছে, কিন্তু তার নাগাল
পাওয়া যায়নি। বার্ধক্য তাই জীবনের নিয়তি।
বার্ধক্য যখন আসে তখন কিছু স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। চুল পাকে, চুল পড়ে যায়, ত্বকে দেখা দেয় বলিরেখা। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসে, শ্রবণশক্তি কমতে থাকে। স্মৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে, পেশিও দুর্বল হয়ে পড়ে। খাওয়ার রুচি কমে যায়, ঘুম কমে যায়। হাড়ের ক্ষয় হয়, লিভার এবং কিডনির কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গতেই জরা বাসা বাঁধে।
বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক পরিবর্তন ছাড়াও বৃদ্ধদের শরীরে নানা রোগব্যাধিও দানা বাঁধে। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিছু কিছু রোগ প্রকৃতিগতভাবে বয়স্ক ব্যক্তিদেরই হয়ে থাকে। যেমন তাঁদের রক্তনালি সরু হয়ে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হূদেরাগ, স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে পারে। প্রবীণ ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক ছোট হয়ে আসে, মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বলে ব্রেইন অ্যাট্রফি। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কেউ কেউ আলঝেইমারস রোগ বা ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত হন। ফলে স্মৃতিশক্তি কমে যায়, আবেগ, অনুভূতি, বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, চিন্তাক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে। আচার-আচরণে অনেকটাই শিশুতে পরিণত হন। একসময় খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন, বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করেন। এ ছাড়া মাথা ঘোরা, হাত-পা কাঁপা, যাকে বলে পার্কিনসন্স ডিজিজসহ নানা ধরনের মস্তিষ্কের রোগও প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়। আবার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অন্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড় ক্ষয়ে যায়, যাকে বলা হয় অস্টিওপরোসিস। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বোধ করেন, মাঝেমধ্যে সামান্য আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। এ ছাড়া অস্টিও আর্থ্রাইটিসের কারণে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়। যেমন হাঁটুতে ব্যথা, কোমরে ব্যথা এমনকি শরীর বেঁকে যায়। ফলে কার্যক্ষমতা আরও কমে যায়। হাঁটাচলায় প্রচণ্ড অসুবিধা হয়। চোখে ছানি পড়াটাও বয়স্ক ব্যক্তিদের রোগ।
পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেটগ্রন্থি বড় হয়ে প্রস্রাবের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে মূত্র ধারণক্ষমতা কমে যায়, প্রস্রাব করতে বেশি সময় লাগে, চাপ দিয়ে প্রস্রাব করতে হয়। মলমূত্র ধরে রাখার ক্ষমতাও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায়। পানি ও লবণের পরিমাণের ব্যাঘাত ঘটে, শীতে বা সামান্য ঠান্ডায়ই তাঁদের দেহ ঠান্ডা হয়ে পড়ে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাঁদের বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, চামড়ার ইনফেকশন ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারও বয়স্ক ব্যক্তিদের বেশি হয়।
আগের চেয়ে এখন প্রবীণ রোগী অনেক বেশি দেখা যায়। এর মূল কারণ, প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা বৃদ্ধি। একসময় মানুষের গড় আয়ু কম ছিল, বৃদ্ধ হওয়াটাই ছিল এক বিরাট সাফল্য। কিন্তু চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ, স্বাস্থ্যসচেতনতা, দ্রুত রোগনির্ণয় ও কার্যকর চিকিৎসার সহজলভ্যতা, পুষ্টি-পরিস্থিতির উন্নতি, নিরাপদ পানীয় জলের সংস্থান, নানা রকমের রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ ইত্যাদি কারণে মানুষ এখন বেশি দিন বেঁচে থাকতে সক্ষম। অনেক জটিল রোগ, যা একসময় মৃত্যুর নামান্তর ছিল, আজ তা অনেকাংশে নিরাময়যোগ্য। এখন স্ট্রোক কিংবা হূদেরাগে আক্রান্ত ব্যক্তিও বেঁচে যাচ্ছেন, কিডনি বা লিভারের রোগে আক্রান্ত মৃতপ্রায় ব্যক্তি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নতুন জীবন লাভ করছেন। এসব সাফল্য আমাদের গড় আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রবীণের সংখ্যাও বাড়ছে আর সেই সঙ্গে বয়স বৃদ্ধিজনিত রোগসমূহের প্রকোপও বেড়ে যাচ্ছে।
শুধু শারীরিক রোগ ব্যাধিই নয়, প্রবীণ ব্যক্তিদের সমস্যা আসলে বহুমাত্রিক। তাঁরা মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও সমস্যায় জর্জরিত। আসলে একজন মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তাঁর নিজের মধ্যেই কিছু কিছু জিনিস দানা বেঁধে ওঠে। যেমন শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, পরনির্ভরশীলতা, অদৃষ্টের ওপর সমর্পণতা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। এগুলোর কারণে মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে নিজেকে অবাঞ্ছিত, পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করেন।
অনেক প্রবীণই বিষণ্নতায় ভোগেন। অনেক সময় এমন অযৌক্তিক ও শিশুসুলভ আচরণ তাঁদের মধ্যে প্রকাশ পায়, যাকে অনেকেই দ্বিতীয় শৈশব বলে মনে করেন।
বয়স্ক রোগী বৃদ্ধির কারণে পারিবারিক, স্বাস্থ্যগত, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় সমস্যাও প্রবল আকার ধারণ করছে। পারিবারিকভাবে অনেক সময় প্রবীণ ব্যক্তিরা অবহেলা-অযত্নের শিকার হয়ে পরিবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন বা পরিবারই তাঁকে ঠেলে দিচ্ছে দূরে। তাঁর নিকটজন এমনকি ছেলেমেয়েও তাঁকে বোঝা মনে করছে। আবার অনেক প্রবীণ নিজেই কারও ওপর বোঝা হয়ে থাকতে চান না, বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিচ্ছেন।
প্রবীণদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার প্রধান কারণ হলো চিকিৎসা-সুবিধার অভাব। তাঁদের জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা অনেক জায়গায় নেই বা থাকলেও সীমিত, বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে। তৃতীয় বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, আর এর শিকার হন প্রবীণ ব্যক্তিরা, বিশেষ করে মহিলারা। আবার গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের আর শহরের প্রবীণ ব্যক্তিদের সমস্যা অনেক সময় ভিন্ন হয়। শহরে অনেক প্রবীণ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ছল কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভোগেন বেশি। নিঃসঙ্গতা বা পারিবারিক অবহেলা এ ক্ষেত্রে দায়ী। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে আর্থিক অসচ্ছলতা বেশি। ভূমিহীন অসচ্ছল গ্রামীণ প্রবীণই আর্থিক দৈন্যে আরও বেশি ভোগেন। ফলে পরনির্ভরশীলতার কারণে খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য-সমস্যাটা গ্রাম পর্যায়ে অত্যন্ত জটিল।
উন্নত বিশ্বে শুধু বৃদ্ধদের জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা বিভাগ থাকে, যাকে বলে জেরিয়াট্রিক মেডিসিন। বৃদ্ধদের যেকোনো স্বাস্থ্যসমস্যা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য তাঁরা বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন।
দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে এখনো বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা অত্যন্ত সীমিত। তাই দেখা যায়, বৃদ্ধরা বাসায় যেমন নিজেদের পরিবার কর্তৃক অবহেলিত হন, তেমনি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও যথাযথ সুবিধা পান না।
 প্রথমে মনে রাখতে হবে, প্রবীণ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা আমাদের পরিবারেরই অংশ। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত সব সময় প্রবীণ ব্যক্তিদের আদর-যত্ন দিয়ে শিশুদের মতো প্রতিপালন করা।
 পৃথিবীর অনেক দেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য বৃদ্ধনিবাস বা ওল্ড হোমের ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনে সে রকম ব্যবস্থা আমাদের দেশেও করতে হবে। তাই বলে অযত্ন-অবহেলায়, দায় এড়ানোর জন্য তাঁদের যেন এসব বৃদ্ধনিবাসে ঠেলে দেওয়া না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
 আমাদের দেশে শুধু সরকারি কর্মচারী চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সামান্য পরিমাণে পেনশন-ভাতা পেয়ে থাকেন। প্রবীণ কি শুধু তাঁরাই হবেন? সরকারি চাকরির বাইরে যাঁরা অন্য পেশায় আছেন বা খেতে-খামারে কাজ করেন, তাঁরা কি বৃদ্ধ হবেন না? তাঁদের জন্যও এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা জরুরি।
 পেনশন বা বয়স্ক ভাতা হিসেবে যে অর্থ দেওয়া হয়, তার পরিমাণটাও সম্মানজনক হওয়া উচিত, যাতে তাঁরা খেয়ে-পরে চলতে পারেন এবং তাঁদের পরনির্ভরশীল হতে না হয়।
 প্রবীণ ব্যক্তিরা যাতে স্বল্প ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা লাভ করতে পারেন, সে জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে তাঁদের জন্য আলাদা বিছানা বরাদ্দ থাকা উচিত। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধ তাঁদের বিনা মূল্যে বা অল্প মূল্যে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রবীণ ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বড় বড় হাসপাতালে বিশেষায়িত বিভাগ খোলা উচিত।
 পরিবারের সদস্যদের বা ছেলেমেয়েদের মনে রাখা উচিত, তাঁরা যেন তাঁদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
 বিভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যথাসম্ভব প্রবীণ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত, যাতে তাঁরা নিজেদের অপ্রয়োজনীয় ও অবহেলিত মনে না করেন।
আমাদের প্রবীণ ব্যক্তিদের জীবন যেন সত্যিকার অর্থেই হয় আনন্দের, শান্তিময়, মধুর স্মৃতিময়। তাঁরা যেন নিজেদের অবহেলিত, পরিবারের ও সমাজের বোঝা মনে না করেন।
এ বি এম আব্দুল্লাহ
ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৩, ২০১২

No comments: