![]() |
দোয়া এবং ভালবাসা | শাহরিয়ার আহমেদ |
অনেক দিন আগের কথা। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ তখন তার নতুন কাঠামো তৈরিতে ব্যস্ত। যদিও মাটিতে লেগে থাকা রক্তের দাগ মুছে যায়নি তখনো। আর মনের ভীতি কিংবা যন্ত্রণা সে তো আর ভুলবার নয়। সাধারনের নুইয়ে পড়া জীবন তখনও মাথা তুলে দাঁড়ায় নি। ভোরের বাতাস তার স্নিগ্ধতা ফিরে পায়নি, চারপাশে কেবলই রক্তের গন্ধ, আর কেমন যেন একটা চেপে থাকা আর্তনাদ। সিমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলগুলোয় তখনও সেনাদের টহল বজায় ছিল। তাদের বুটের অপ্রিয় শব্দে ঘুম হতে চায়না বাচ্চা আর বুড়োদের। গল্পটি ঠিক তখনকার।
রাতভর টহলের পর তাবুতে ফিরে এলো ইভান। ভীষণ ক্লান্ত। অল্প সময়ে গোসলটা সেরে নিল সে। এরপর একটা লম্বা ঘুমের জন্য বিছানায় গেল। তারপর কিছুক্ষণ নানান ভাবনায় ডুবে থাকলেও ক্লান্তিতে চোখের পাতাদুটি একসময় ঠিকই বুজে গেল। দুপুর নাগাদ ঘুম ভেঙ্গে কিছু খেয়ে নিল সে। তারপর আবার ঘুমের দেশে। বড্ড আজব। সুখ আসে, সুখ যায়, দুঃখ আসে, ঋতু বদলায়, বদলে যায় সিপাহীদের ঠিকানা। দুচোখে তবু ঘুমের কোন অভাব নেই। বিকেলে আবার ঘুম ভাঙ্গে। তখন অনেকেই মাঠে খেলায় মত্ত হয়, কেউ কেউ বাড়িতে চিঠি লেখে।
ইভান নির্ভেজাল। খেলাটা তাকে টানেনা, আর আপন বলে যেহেতু কেউ নেই, তাই নেই চিঠি লেখার প্রয়োজনবোধ। আছে অবশ্য একটু ভ্রমণের শখ। তাই ক্যামেরাটা নিয়ে পাহাড়ের গা বেঁয়ে হেঁটে চলল সে। কিছু ছবিও সংগ্রহ করল। খুব সুন্দর একখানা প্রজাপতি নজর কেড়ে নিল তার। প্রজাপতির একটা ছবি না নিয়ে ফিরতে ইচ্ছা করছিলো না। প্রজাপতিটা ভারি চঞ্চল। রঙ্গিন ডানা ঝাপটে বারবার ফোকাসের বাইরে চলে যাচ্ছিল সে। হঠাত করেই মুক্তোর দানার মতন বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। এটা যদিও পাহাড়ি আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য। ইভান ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, সে প্রজাপতির ছবিটা তুলতেই চাইছিল।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, আকাশে মৃদু মেঘের আনাগোনা, তাদের গুড়গুড় ডাক আর চমক, হিম বাতাস, সাথে শীতশীত অনুভূতি যখন বুকের কাঁপন বাড়িয়ে দিতে চায়; ঠিক তখনি ক্যামেরার ফোকাসে লক্ষ্য নিবিষ্ট করা ইভানের নয়ন প্রথম বারের মতন দর্শন করল চিত্রার মুখ। কি অপরূপ, কি সম্মোহনী, কি জাদুকরী ওই চেহারা। ইভান অপলক চেয়ে দেখা ছাড়া আর কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সময় বুঝি থেমে গিয়েছিল। যখন সম্মোহন ভাঙল, মেয়েটি আর সেখানে ছিল না। কিছুক্ষণ তাকে খুঁজল ইভান। পেলনা। ভিজে যাওয়া শরীর আর অবনত মস্তকে তাই তাবুতে ফিরে এলো। ওই চেহারাটা ভুলতে পারছিল না সে। নিজেকে একটাই প্রশ্ন বারবার করে চলল, কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটি?
দুই
এরপর থেকে এমন একটি মুহূর্ত কাটেনি যখন দুটি চোখ সেই চেহারাটা আর একটি বার দেখতে চায় নি। আজকাল ঘুমও কেমন জানি নিরুত্তাপ। নিজের সমস্ত কাজ থেকে ধীরে ধীরে মনোযোগ হারিয়ে ফেলছিল ইভান। এমন একটি বিকেল নেই, যেদিন ক্যমেরাটা নিয়ে পাহাড়ি পথে মেয়েটির খোঁজে বের হয়নি সে। প্রায় মাস ঘুরে এলো, তার দেখা নেই। ইভান ভেবেই নিয়েছিল, মেয়েটি একটি স্বপ্নমাত্র, আর কিছু নয়। সেনা টহলের আনুষ্ঠানিকতাও প্রায় শেষের দিকে। আর একটি মাস পরই ফিরে যেতে হবে ঘরে। হয়তো আর দেখা পাওয়া যাবেনা মেয়েটির। একটা মোহময় স্বপ্ন হয়ে কেবলই ইভানের খেয়ালে বেঁচে রইবে সে।
কিন্তু ঈশ্বর যা ভেবে রেখেছেন, তা কেউ জানেনা। সেদিনও বিকেল সাঁঝের সাথে গোধূলিতে মিশেছিল। পাহাড়ি রাস্তা স্বভাবতই একটু আঁকাবাঁকা। তাঁবুতে ফিরতে ছোট্ট একটা খাল পার হতে হত। খালের দুটি পাড় সাঁকো দিয়ে সংযুক্ত। সাঁকোর গোঁড়ায় এসে একটু থেমে গেল ইভান। একটা দীর্ঘশ্বাস টানছিল সে। এমন সময় একটা মেয়ে কণ্ঠ তাকে চমকিত করে দিল। তার পেছনে দাড়িয়ে কয়েকটি মেয়ে। যাদের একজন সেই জন, যাকে ইভান রোজ সপ্নে দেখে। ইভান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। অমনোযোগী ভঙ্গিতে একবার ইভানকে দেখে তারপর সাঁকো পেরিয়ে পথ চলছিল মেয়েটি। ইভান আজ তাদের পিছু নিল। সঙ্গীদের বিদায় দিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরল মেয়েটি। দূরে দাড়িয়ে সবই লক্ষ্য করছিল ইভান। এরপর সে কাম্পে ফিরে এলো।
পরদিন বিকেলে মেয়েটির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল ইভান। দরজা খুলে দিল মেয়েটি। অপরিচিত মানুষটিকে দেখেই হয়ত খুব অবাক হয়েছিল সে। "কে আপনি?" জানতে চাইল মেয়েটি। "আমি ইভান, সেনাবাহিনীতে কাজ করছি। এক গ্লাস পানি হবে?" সহজ ভাবে বলল ইভান। "ভেতরে আসুন। বসুন। আমি পানি নিয়ে আসছি।" ঘরের ভেতরে চলে গেল মেয়েটি। মেয়েটির এমন সরল বিশ্বস্ততা ইভানকে বেশ অবাক করে দিল। ইভান কক্ষের দেয়ালগুলো আর তাতে টানানো ছবিগুলো দেখছিল। দেখছিল ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র। এমন সময় বুড়ো গোছের একজন ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করলেন। কথা বলে জানা গেল লোকটি এই পরিবারের বাবা। তার মেয়ের নাম চিত্রা। চিত্রার মা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। এর পর থেকে বাবাই তার সব। লোকটির সাথে খুব অল্প সময়েই ভাল গল্প জমে উঠল ইভানের। লোকটি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন। যদিও প্রথম জীবনে তিনি একজন সেনাসদস্য হতে চেয়েছিলেন। তাই সেনাদের তিনি খুব পছন্দ করতেন। আর তাছাড়া ইভানের এক্স-ফ্যাক্টর বেশ জাদুকরী। ঐ দিন পানি আর সান্ধ্যভোজটা ভালই উপভোগ্য হয়েছিল ইভানের। বাবা ইভানকে পরদিন আবারও আমন্ত্রণ করলেন। যথারীতি ইভান পরদিনও এলো। এদিনও তাদের গল্প জমেছিল বেশ। ইভান আর বাবার গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে শুনত চিত্রা। যুদ্ধের গল্প, বিপ্লবের গল্প, শান্তি প্রতিষ্ঠার গল্প, দেশ ভ্রমনের গল্প আরও কত কি। বাবার কাছ থেকে চিত্রা সম্পর্কেও আগ্রহের সবটুকু প্রশমন করে সবটা তথ্য জেনে নিল ইভান। এরপর সান্ধ্যভোজ। আর বিদায় বেলা চিত্রা দরজা বন্ধ করতে ইভানের পিছু পিছু আসত। তখন প্রাণ ভরে তাকে একবার দেখে নেয়া আর নিরব চোখাচোখি। পরদিন আবার এরই পুনরাবৃত্তি।
তিন
কয়েকটি দিন এভাবেই কেটে গেল। চিত্রাকে এসময় খুব ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করত ইভান। তার কয়েকটি গুণ খুবই মোহনীয়। যেগুলো ছিল, সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা, উদারতা, বিচক্ষণতা, নিজেকে লুকানোর ক্ষমতা, মুগ্ধতা। আর সবচেয়ে বড় গুণ যেটি ইভানের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, তার মুক্তাঝরা হাসি। যাতে কোনও খুঁত নেই। চিত্রা যখন হাসত, তার পুরোটা শরীর তার সাথে হাসত, এমনকি তার চুলও।
ইভান জানত সে কি চায়। তাই সে ঠিক করল আজই চিত্রাকে মনের কথাগুলো বলবে। কারন আজ নয়, তো কখনই নয়। সেই সন্ধ্যাতেও ইভানের যাবার বেলায় চিত্রা তাকে বিদায় দিতে সদর দরজা পর্যন্ত এসেছে। ইভান সাহস জোগাতে পারছিল না। সে বিদায় নিলো। চিত্রা দরজা আটকে দিল। ইভান দরজার বাইরে খানিকক্ষণ দাড়িয়ে রইল। তারপর আবার কড়া নাড়ল দরজায়। দরজা খুলে দিল চিত্রা।
"কিছু ফেলে গেছেন?" বিনয়ী হয়ে জানতে চাইল সে।
"চিত্রা (একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করল ইভান), তুমি আমার হবে?"
এরপর সবকিছু থমথমে। ইভান আর চিত্রা একে অন্যের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে রইল। তারপর ইভান বিদায় নিলো। সারা রাত চিত্রার জবাবের অপেক্ষায় রইল সে। চিত্রার কাঁচা সোনা রুপ মর্তের পৃথিবীতে অতুলনীয়, তবে ইভানও কম সুদর্শন নয়। সুউচ্চ গ্রীবা, প্রসারিত বাহু, মোহনীয় তারুণ্য, যা ঘুম কেড়ে নেবে যে কোন রমণীর। তাই ইভান বেশ আত্মবিশ্বাসী।
পরদিন যথারীতি ইভান, চিত্রার বাড়িতে উপস্থিত হলো। পুরোটা বিকেল তাদের সাথেই পার করল। আর মনে মনে চিত্রার জবাবের জন্য প্রতিক্ষা করতে লাগল। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। তাই যাবার বেলায় চিত্রাকে জিজ্ঞাসা করল, "গতকাল তোমার কাছে একখানা প্রশ্ন রেখেছিলাম। তুমি কি তার জবাব তৈরি করেছ?"
"বাবাকে জানাতে সাহস হয়নি।" একটু লাজুক হাসিতে নিজেকে লুকিয়ে, চোখজোড়া ঈষৎ অবনত করে চিত্রার জবাব।
একটু দাড়িয়ে তারপর চিত্রার বাবার কাছে আবার ফিরে গেল ইভান।
"স্যার, আমি আপনার মেয়েকে ভালবাসি। ওকে আমার ঘরের বধু বানাতে চাই। আপনার কাছে ওর হাত চাইতে এসেছি। আপনি কি আপনার মেয়ের জন্য আমাকে যথেষ্ট যোগ্য মনে করেন?" বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করল ইভান। বাবা চিত্রার দিকে তাকাতেই চিত্রার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। আঁচলে মুখ লুকিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল সে। আর তার এই নিরবতা অনেক কথা বলে গেল। বাবার অসম্মতি প্রকাশের কোন কারণই আর রইল না।
সুতরাং সার্থক হলো এই প্রেম। পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে সকল ধর্মীয় এবং সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ইভান-চিত্রার বিবাহ সুসম্পন্ন হলো।
চার
অল্প কিছুদিনেই সেনা টহল শেষ হলো। নতুন বউকে সাথে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো ইভান। বনভোজনের মতন আনন্দে কাটতে লাগল সময়। তাদের মধুর সংসার জীবন ভালোবাসার স্রোতে ভালই চলছিল। ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, খেয়াল কোন কিছুর অভাব ছিল না। এভাবেই দিনানিপাত হচ্ছিল।
হঠাতই একদিন ইভানের শরীরটা ভীষণ আসুস্থ হয়ে পড়ল। খুব মাথাব্যথা করত। একদিন জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছিল সে। এবার আর অপেক্ষা নয়। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হলো তাকে। তার মাথাসহ পুরোটা শরীর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকের ভ্রু কুঁচকে উঠল। বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল তাকে। এরপর চিকিৎসক যা বললেন, তাতে ইভানের পিলে চমকে উঠল। তার মাথায় ক্যান্সার সেল ধরা পড়েছে। হয়তো তার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। এ জীবনকে আর বছরের হিসেবে নয় বরং কিছু মুহূর্তের হিসেবে বাঁচতে হবে তাকে। জন্ম তো মৃত্যুরই নিমিত্তে। মরতে ভয় নেই। কিন্তু চিত্রা? সূর্যের ডুবতে বসা লগ্নে সে এই জীবনে কেন এলো? খানিক বাদে আঁধার ঘনিয়ে এলে একা এত বড় পথ ও পাড়ি দেবে কি করে? ইভানের চোখজোড়া সিক্ত হয়ে এলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। হয়তো আর কিছুই করবার বাকি নাই। এই মুহূর্তে ঘরে ফিরতে হবে। চিত্রার কোলে মাথা রেখেই যদি নিঃশ্বাস ফুরিয়ে যায়, তবুও স্বস্তি। কিন্তু চিত্রাকে সে এসবের কিছুই বলতে চায় না। জীবিত থাকতে ইভান, চিত্রার চোখে জল সহ্য করতে পারবে না।
কিন্তু সব হিসেব এমনটা ছিল না। মা, বন্ধু আর ঈশ্বরের নিকট কোন কথাই গোপন থাকে না। ইভানের অসুস্থতা চিত্রার কাছে গোপন ছিল না। সে সবই জানত। তবু সে ইভানকে কিছুই বলে নি। তাকে দুঃখী করতে চায় নি। সে ঈশ্বরের নিকট দিন রাত্রি প্রার্থনা করত। চিত্রা এমন অভিনয় করত যেন কিছুই সে জানেনা। স্বাভাবিক আচরন করত ইভানের সাথে। আর সময় পেলেই নিবিষ্ট হতো প্রার্থনায় "হে ঈশ্বর পথ দেখাও।"
ধীরে ধীরে ইভানের শারিরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। সকল দোয়া, সকল মানত যখন অর্থহীন জ্ঞান করা হচ্ছিল, তখন এক রাতে চিত্রা সপ্নে একটা সবুজে ঘেরা সুন্দর জায়গা দেখতে পেল। সেখানে প্রায় ভেঙে পড়া একটা স্থাপত্য চোখে পড়ে। পরগাছার আবাস যাকে সবুজ করে তুলেছিল। জায়গাটি একটা উঁচু টিলার মতন। সমতল থেকে ৫১টি সিঁড়ি বেঁয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়। তার মনে হলো কেউ তাকে ডেকে বলছে, প্রিয় কিছু ত্যাগের বিনিময়ে এই স্থানে এসে দোয়া করলে তার একটি দোয়া কবুল হবে। বিষয়টি কাকতালীয়, ঠিক একই সপ্ন ইভানও দেখল। প্রথম রাত্রে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও দ্বিতীয় রাত্রে আবারও একই সপ্ন দেখায় তাদের মনে আশার সঞ্চার হলো। কিন্তু কেউ নিজের সপ্নের ব্যপারে অন্যকে জানালো না। যদিও তারা দুজনেই জানত, তারা কি চাইবে।
পাঁচ
বিকেলে ইভান আর চিত্রা দুজনেই সপ্নে দেখা জায়গাটিতে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। দুজনেরই প্রয়োজন ছিল একে অপরের জন্য একটু বাহানার। ইভানই প্রথম মুখ খুলল। " শরীরটা একটু আড়মোড়া ভাঙতে চাইছে। ভাবছি শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোথাও থেকে কিছুদিন বেড়িয়ে আসি। তুমি যাবে?"
মনতো এমনটাই চাইছিল। তাই মানা করবার কারন ছিল না চিত্রার কাছে। "মন্দ হয়না। তবে যাবে কোথায়?" জানতে চাইল চিত্রা।
"তুমি বল" বলল ইভান।
"চল কোন সমুদ্রের পাড়ে যাই। যেখানে পাহাড় আছে, সেখানে যাই। ঘুরে আসি কোন আরণ্য থেকে। এমন কোথাও, যেখানে নেই কোলাহল, রয়েছে পবিত্রতা। যার চারপাশ সবুজ ছায়াঘেরা, আর তার সামনে প্রবাহমান উত্তাল সমুদ্র। যেখান থেকে আকাশ আরও বেশি নীল দেখা যাবে"।
যেন ইভানের ঠিক মনের কথাটি। তাই সম্মত হলো সেও। এরপর বেড়িয়ে পড়া।
সপ্নে দেখা সেই জায়গাটির খোঁজে। অবশেষে মিলল এমন একটি স্থান যা দেখতে সপ্নে দেখা সেই জায়গাটির মতো। হিমালয়ের পাদদেশে। ভারত মাহাসাগরের খুব কাছে। একটা উচু টিলা। যেখানে অর্ধভঙ্গুর একটা মসজিদ রয়েছে। যার দেয়ালে ফার্ন আর শ্যাওলা সবুজ হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের মতে, মসজিদটি অনেক সময়ের পুরনো। এখানে তেমন কেউ আসেনা। তবে কেউ যদি বিশ্বাস নিয়ে এখানে এসে কিছু প্রার্থনা করে তবে ঈশ্বর কর্তৃক তা মঞ্জুর হয়। ওপরে চড়ার সময় ইভান আর চিত্রা দুজনেই একান্নটি সিঁড়ি গণনা করেছে। তাদের বুঝতে বাকি নেই, যে তারা তাদের গন্তব্ব্যে চলে এসেছে। চিত্রা প্রথমে গিয়ে দুই হাত তুলে ঈশ্বরের নিকট তার দোয়াগুলো নিয়ে অবনত হলো। চিত্রাকে বুঝতে দেবেনা বলে ইভান দুরেই দাড়িয়ে রইল। চিত্রা জানত প্রাণের বিনিময় কেবল প্রাণ হতে পারে। তাই সে ঈশ্বরের কাছে নিজের প্রাণের বিনিময়ে ইভানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে দোয়া করল। দূরে দাঁড়ানো ইভান কি ত্যাগ করবে আর কিই বা চাইবে তা স্থির করতে পারল না। জীবনের অন্তিম লগ্নে নিজের জন্য চাইবার আর কিছুই নেই। তাই সে কেবল এতটুকুই চাইল যেন চিত্রার সকল চাওয়া, সকল দোয়া, সকল মানত ঈশ্বর গ্রাহ্য করেন। আর তার মৃত্যুর পর ঈশ্বর যেন চিত্রাকে চিরসুখী রাখেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পূর্বেই তারা আবার বেড়িয়ে পড়ল। অনেকটা সময় নিরবতার মাঝে কেটে গেল।
"চিত্রা, আমি প্যরিস যেতে চাই। প্রেমের নগরীতে।" আনমনেই বলল ইভান।
"তাহলে চলো। দেরি কিসের?" জবাব দিলো চিত্রা।
ছয়
শেইনের তীরে 'পুঁন দে লা আর্শসিভিশে' ব্রিজ। নিজেদের প্রেমের অমরত্ব চেয়ে এখানে একটি তালা ঝুলিয়ে দিল ইভান আর চিত্রা। যার চাবি দূরে ছুঁড়ে ফেলা হলো শেইনের স্রোতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নাডা নামের এক সার্বিয়ান বালিকা প্রেমে পড়েছিল স্থানীয় এক অফিসার যুবকের। যার নাম ছিল রেলজা। কিছুদিন পর তাদের প্রেম কাহিনী সার্বিয়ার বানজার প্রদেশে খুব আলোচিত হয়। তার কিছুদিন পরই রেলজা যুদ্ধ করতে চলে যায় গ্রীসে। সেখানে গিয়ে রেলজা এক গ্রীক তরুণীর প্রেমে পড়ে এবং নাডার সাথে প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটে। প্রেম বিচ্ছেদের পর নাডা কখনোই এই দুঃখ ভুলতে পারেনি এবং এক সময় এই দুঃখ নিয়েই ধীরে ধীরে তাকে মরে যেতে হয়।
তারপর থেকে সার্বিয়ার বানজার এলাকার মেয়েরা সবসময় চাইতো তাদের প্রেমিককে ধরে রাখতে। তারা চাইতো তাদের প্রেমিক যেন কখনো তাদের ছেড়ে না যায়। তাই তারা একটি তালার মাঝে প্রেমিক-প্রেমিকার দুজনের নামের প্রথম অক্ষর লিখে সেটি ঝুলিয়ে দিত বানজারের এই ব্রিজে যেখানে নাডা এবং রেলজা প্রায় বিকেলেই দেখা করতো।
এবং আজ যেখানে দাড়িয়ে আছে ইভান আর চিত্রা।
সামনে ভালবাসা দিবস। ইভানের ইচ্ছা ঐ দিনেই সে আইফেল টাওয়ারের নিচে চিত্রাকে তার অসুস্থতার ব্যপারে বলবে। আর তাকে বলবে নিজের ভালবাসার কথা। কিন্তু গত কয়েকটি দিন চিত্রার শরীরটা খুব একটা ভাল নেই। সময় যত গড়াতে লাগল সে আরও বেশি অসুস্থ হতে শুরু করল। চিকিৎসায় কিছুই সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই অসুস্থতার ব্যপারে জানত শুধু চিত্রাই। সে জানত যে, তার হাতে সময় আর খুব বেশি নেই। শুধুই এখন ইভানের হাত ধরে একবার আইফেল টাওয়ার যেতে ইচ্ছা হয়। আর কিছু নয়।
অবশেষে এলো সেই দিন। চিত্রা ভীষণ অসুস্থ। সে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ইভান তার পাশে। "ইভান, আমি আইফেল টাওয়ার যাব। আমাকে নিয়ে চলো।" বলল চিত্রা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিত্রার জিদের কাছে হার মানতে হলো ইভানকে। শেইন নদীতে নৌকা ভাসিয়ে তারা এগিয়ে চলল আইফেলের দিকে। সন্ধ্যা তখন আসন্ন। গোধূলি সময়। ইভানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে চিত্রা। নৌকাটা তীরের যত নিকটে আসছিল, কোলাহল ততই বাড়ছিল। এমন সময় আইফেল টাওয়ার আলোকিত হয়ে উঠল। নৌকা তীরে পোঁছে গেল। "চিত্রা? ওঠো। আমরা এসে গেছি।" চিত্রা আর জবাব দিলো না। ,সে আর চোখ খুলল না। এই ঘুম পরপারের। মৃত্যুর পূর্বেই আরও একবার মরে গেল ইভান। ভালবাসা তার দুয়ারে দাড়িয়ে হাত ছেড়ে দিলো।
সাত
ইভান বেঁচে রইল। আজ সে বুঝতে পারল চিত্রা ঐ দিন ঈশ্বরের নিকট কি দোয়া করেছিল। চিত্রা তবে সবই জানত। তার বুকে কতনা কথা জমে ছিল, কত কান্না ছিল যা অশ্রু হয়ে কখনো ঝরেনি। ইভান আমৃত্যু নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। তার বিশ্বাস ছিল চিত্রা ফিরে আসবে একদিন। সে তার জগত ফেলে পরবর্তী সারা জীবন হিমালয়ের পাদদেশের সেই মসজিদটিতে চিত্রাকে ফিরে পাবার জন্য ঈশ্বরের নিকট দোয়া করেছে। চিত্রা ফিরে আসেনি।
অপেক্ষার লম্বা প্রহর পার হয়ে একদিন ইভানের জীবনের সমাপ্তি হলো। তার আত্মা শরীরকে বিদায় দিয়ে এমন এক জগতে গিয়ে পৌঁছল যেখানে এর আগে কেউ আসেনি। চারিদিকে পাহাড়ি সবুজ। নীল সমুদ্র। অপরুপ ঝর্ণাধারা, আর রংবেরং ফুলের বাগান। খুব সুন্দর একটা প্রজাপতি তার নজর কেড়ে নিলো। রঙের ডানা ঝাপটে সেটি উড়ে চলল। ইভান তাকে অনুসরণ করে চলল। ঝরনার পানিতে পা ডুবিয়ে একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখল ইভান। প্রজাপতিটি গিয়ে মেয়েটির মেঘ কালো চুলের ওপর বসলো। মেয়েটির পরিচয় জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছিল ইভানের। সে ধিরপায়ে এগিয়ে গেল। আর মেয়েটির কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটি ফিরে তাকাতেই সেই প্রথম সাক্ষাতের মতন সম্মোহিত হয়ে পড়ল ইভান। কারন এই মেয়েটিই তার চিত্রা। চিত্রার চুলের ভাঁজে একখানা চিঠির মতন কিছু দেখতে পেল ইভান। তাতে লেখা রয়েছে, " তোমার আমানত তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া হলো। তোমাদের ভালবাসার পরীক্ষায় তোমরা উত্তীর্ণ। এখানে আর কোন বাধা নেই। তোমরা এখানে থাকবে চিরকাল। তোমাদের প্রেম আর কখনো কমবে না, তোমাদের প্রেমে আর কখনো ছেদ পড়বে না।"
" কি লেখা এতে?" জানতে চাইল চিত্রা।
" তুমি। তোমার নাম। শুধু তুমি।" এটি ছিল ইভানের জবাব। তারপর এক গভীর আলিঙ্গনে মিশে গেল দুজনে। তাদের সময় এখানেই থেমে রইবে হাজার বছর। তাদের প্রেম চির নতুন আজও। পৃথিবীতে প্রতিটি জোড়া ইভান-চিত্রার প্রেমের প্রতিনিধি। ইভান আর চিত্রা স্বর্গ থেকে তাদের দেখে আর দোয়া করে তাদের জন্য।
" হে ঈশ্বর, সার্থক হোক পৃথিবীর প্রতিটি ভালবাসা"
রাতভর টহলের পর তাবুতে ফিরে এলো ইভান। ভীষণ ক্লান্ত। অল্প সময়ে গোসলটা সেরে নিল সে। এরপর একটা লম্বা ঘুমের জন্য বিছানায় গেল। তারপর কিছুক্ষণ নানান ভাবনায় ডুবে থাকলেও ক্লান্তিতে চোখের পাতাদুটি একসময় ঠিকই বুজে গেল। দুপুর নাগাদ ঘুম ভেঙ্গে কিছু খেয়ে নিল সে। তারপর আবার ঘুমের দেশে। বড্ড আজব। সুখ আসে, সুখ যায়, দুঃখ আসে, ঋতু বদলায়, বদলে যায় সিপাহীদের ঠিকানা। দুচোখে তবু ঘুমের কোন অভাব নেই। বিকেলে আবার ঘুম ভাঙ্গে। তখন অনেকেই মাঠে খেলায় মত্ত হয়, কেউ কেউ বাড়িতে চিঠি লেখে।
ইভান নির্ভেজাল। খেলাটা তাকে টানেনা, আর আপন বলে যেহেতু কেউ নেই, তাই নেই চিঠি লেখার প্রয়োজনবোধ। আছে অবশ্য একটু ভ্রমণের শখ। তাই ক্যামেরাটা নিয়ে পাহাড়ের গা বেঁয়ে হেঁটে চলল সে। কিছু ছবিও সংগ্রহ করল। খুব সুন্দর একখানা প্রজাপতি নজর কেড়ে নিল তার। প্রজাপতির একটা ছবি না নিয়ে ফিরতে ইচ্ছা করছিলো না। প্রজাপতিটা ভারি চঞ্চল। রঙ্গিন ডানা ঝাপটে বারবার ফোকাসের বাইরে চলে যাচ্ছিল সে। হঠাত করেই মুক্তোর দানার মতন বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। এটা যদিও পাহাড়ি আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য। ইভান ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, সে প্রজাপতির ছবিটা তুলতেই চাইছিল।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, আকাশে মৃদু মেঘের আনাগোনা, তাদের গুড়গুড় ডাক আর চমক, হিম বাতাস, সাথে শীতশীত অনুভূতি যখন বুকের কাঁপন বাড়িয়ে দিতে চায়; ঠিক তখনি ক্যামেরার ফোকাসে লক্ষ্য নিবিষ্ট করা ইভানের নয়ন প্রথম বারের মতন দর্শন করল চিত্রার মুখ। কি অপরূপ, কি সম্মোহনী, কি জাদুকরী ওই চেহারা। ইভান অপলক চেয়ে দেখা ছাড়া আর কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সময় বুঝি থেমে গিয়েছিল। যখন সম্মোহন ভাঙল, মেয়েটি আর সেখানে ছিল না। কিছুক্ষণ তাকে খুঁজল ইভান। পেলনা। ভিজে যাওয়া শরীর আর অবনত মস্তকে তাই তাবুতে ফিরে এলো। ওই চেহারাটা ভুলতে পারছিল না সে। নিজেকে একটাই প্রশ্ন বারবার করে চলল, কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটি?
দুই
এরপর থেকে এমন একটি মুহূর্ত কাটেনি যখন দুটি চোখ সেই চেহারাটা আর একটি বার দেখতে চায় নি। আজকাল ঘুমও কেমন জানি নিরুত্তাপ। নিজের সমস্ত কাজ থেকে ধীরে ধীরে মনোযোগ হারিয়ে ফেলছিল ইভান। এমন একটি বিকেল নেই, যেদিন ক্যমেরাটা নিয়ে পাহাড়ি পথে মেয়েটির খোঁজে বের হয়নি সে। প্রায় মাস ঘুরে এলো, তার দেখা নেই। ইভান ভেবেই নিয়েছিল, মেয়েটি একটি স্বপ্নমাত্র, আর কিছু নয়। সেনা টহলের আনুষ্ঠানিকতাও প্রায় শেষের দিকে। আর একটি মাস পরই ফিরে যেতে হবে ঘরে। হয়তো আর দেখা পাওয়া যাবেনা মেয়েটির। একটা মোহময় স্বপ্ন হয়ে কেবলই ইভানের খেয়ালে বেঁচে রইবে সে।
কিন্তু ঈশ্বর যা ভেবে রেখেছেন, তা কেউ জানেনা। সেদিনও বিকেল সাঁঝের সাথে গোধূলিতে মিশেছিল। পাহাড়ি রাস্তা স্বভাবতই একটু আঁকাবাঁকা। তাঁবুতে ফিরতে ছোট্ট একটা খাল পার হতে হত। খালের দুটি পাড় সাঁকো দিয়ে সংযুক্ত। সাঁকোর গোঁড়ায় এসে একটু থেমে গেল ইভান। একটা দীর্ঘশ্বাস টানছিল সে। এমন সময় একটা মেয়ে কণ্ঠ তাকে চমকিত করে দিল। তার পেছনে দাড়িয়ে কয়েকটি মেয়ে। যাদের একজন সেই জন, যাকে ইভান রোজ সপ্নে দেখে। ইভান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। অমনোযোগী ভঙ্গিতে একবার ইভানকে দেখে তারপর সাঁকো পেরিয়ে পথ চলছিল মেয়েটি। ইভান আজ তাদের পিছু নিল। সঙ্গীদের বিদায় দিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরল মেয়েটি। দূরে দাড়িয়ে সবই লক্ষ্য করছিল ইভান। এরপর সে কাম্পে ফিরে এলো।
পরদিন বিকেলে মেয়েটির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল ইভান। দরজা খুলে দিল মেয়েটি। অপরিচিত মানুষটিকে দেখেই হয়ত খুব অবাক হয়েছিল সে। "কে আপনি?" জানতে চাইল মেয়েটি। "আমি ইভান, সেনাবাহিনীতে কাজ করছি। এক গ্লাস পানি হবে?" সহজ ভাবে বলল ইভান। "ভেতরে আসুন। বসুন। আমি পানি নিয়ে আসছি।" ঘরের ভেতরে চলে গেল মেয়েটি। মেয়েটির এমন সরল বিশ্বস্ততা ইভানকে বেশ অবাক করে দিল। ইভান কক্ষের দেয়ালগুলো আর তাতে টানানো ছবিগুলো দেখছিল। দেখছিল ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র। এমন সময় বুড়ো গোছের একজন ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করলেন। কথা বলে জানা গেল লোকটি এই পরিবারের বাবা। তার মেয়ের নাম চিত্রা। চিত্রার মা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। এর পর থেকে বাবাই তার সব। লোকটির সাথে খুব অল্প সময়েই ভাল গল্প জমে উঠল ইভানের। লোকটি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন। যদিও প্রথম জীবনে তিনি একজন সেনাসদস্য হতে চেয়েছিলেন। তাই সেনাদের তিনি খুব পছন্দ করতেন। আর তাছাড়া ইভানের এক্স-ফ্যাক্টর বেশ জাদুকরী। ঐ দিন পানি আর সান্ধ্যভোজটা ভালই উপভোগ্য হয়েছিল ইভানের। বাবা ইভানকে পরদিন আবারও আমন্ত্রণ করলেন। যথারীতি ইভান পরদিনও এলো। এদিনও তাদের গল্প জমেছিল বেশ। ইভান আর বাবার গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে শুনত চিত্রা। যুদ্ধের গল্প, বিপ্লবের গল্প, শান্তি প্রতিষ্ঠার গল্প, দেশ ভ্রমনের গল্প আরও কত কি। বাবার কাছ থেকে চিত্রা সম্পর্কেও আগ্রহের সবটুকু প্রশমন করে সবটা তথ্য জেনে নিল ইভান। এরপর সান্ধ্যভোজ। আর বিদায় বেলা চিত্রা দরজা বন্ধ করতে ইভানের পিছু পিছু আসত। তখন প্রাণ ভরে তাকে একবার দেখে নেয়া আর নিরব চোখাচোখি। পরদিন আবার এরই পুনরাবৃত্তি।
তিন
কয়েকটি দিন এভাবেই কেটে গেল। চিত্রাকে এসময় খুব ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করত ইভান। তার কয়েকটি গুণ খুবই মোহনীয়। যেগুলো ছিল, সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা, উদারতা, বিচক্ষণতা, নিজেকে লুকানোর ক্ষমতা, মুগ্ধতা। আর সবচেয়ে বড় গুণ যেটি ইভানের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, তার মুক্তাঝরা হাসি। যাতে কোনও খুঁত নেই। চিত্রা যখন হাসত, তার পুরোটা শরীর তার সাথে হাসত, এমনকি তার চুলও।
ইভান জানত সে কি চায়। তাই সে ঠিক করল আজই চিত্রাকে মনের কথাগুলো বলবে। কারন আজ নয়, তো কখনই নয়। সেই সন্ধ্যাতেও ইভানের যাবার বেলায় চিত্রা তাকে বিদায় দিতে সদর দরজা পর্যন্ত এসেছে। ইভান সাহস জোগাতে পারছিল না। সে বিদায় নিলো। চিত্রা দরজা আটকে দিল। ইভান দরজার বাইরে খানিকক্ষণ দাড়িয়ে রইল। তারপর আবার কড়া নাড়ল দরজায়। দরজা খুলে দিল চিত্রা।
"কিছু ফেলে গেছেন?" বিনয়ী হয়ে জানতে চাইল সে।
"চিত্রা (একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করল ইভান), তুমি আমার হবে?"
এরপর সবকিছু থমথমে। ইভান আর চিত্রা একে অন্যের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে রইল। তারপর ইভান বিদায় নিলো। সারা রাত চিত্রার জবাবের অপেক্ষায় রইল সে। চিত্রার কাঁচা সোনা রুপ মর্তের পৃথিবীতে অতুলনীয়, তবে ইভানও কম সুদর্শন নয়। সুউচ্চ গ্রীবা, প্রসারিত বাহু, মোহনীয় তারুণ্য, যা ঘুম কেড়ে নেবে যে কোন রমণীর। তাই ইভান বেশ আত্মবিশ্বাসী।
পরদিন যথারীতি ইভান, চিত্রার বাড়িতে উপস্থিত হলো। পুরোটা বিকেল তাদের সাথেই পার করল। আর মনে মনে চিত্রার জবাবের জন্য প্রতিক্ষা করতে লাগল। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। তাই যাবার বেলায় চিত্রাকে জিজ্ঞাসা করল, "গতকাল তোমার কাছে একখানা প্রশ্ন রেখেছিলাম। তুমি কি তার জবাব তৈরি করেছ?"
"বাবাকে জানাতে সাহস হয়নি।" একটু লাজুক হাসিতে নিজেকে লুকিয়ে, চোখজোড়া ঈষৎ অবনত করে চিত্রার জবাব।
একটু দাড়িয়ে তারপর চিত্রার বাবার কাছে আবার ফিরে গেল ইভান।
"স্যার, আমি আপনার মেয়েকে ভালবাসি। ওকে আমার ঘরের বধু বানাতে চাই। আপনার কাছে ওর হাত চাইতে এসেছি। আপনি কি আপনার মেয়ের জন্য আমাকে যথেষ্ট যোগ্য মনে করেন?" বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করল ইভান। বাবা চিত্রার দিকে তাকাতেই চিত্রার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। আঁচলে মুখ লুকিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল সে। আর তার এই নিরবতা অনেক কথা বলে গেল। বাবার অসম্মতি প্রকাশের কোন কারণই আর রইল না।
সুতরাং সার্থক হলো এই প্রেম। পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে সকল ধর্মীয় এবং সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ইভান-চিত্রার বিবাহ সুসম্পন্ন হলো।
চার
অল্প কিছুদিনেই সেনা টহল শেষ হলো। নতুন বউকে সাথে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো ইভান। বনভোজনের মতন আনন্দে কাটতে লাগল সময়। তাদের মধুর সংসার জীবন ভালোবাসার স্রোতে ভালই চলছিল। ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, খেয়াল কোন কিছুর অভাব ছিল না। এভাবেই দিনানিপাত হচ্ছিল।
হঠাতই একদিন ইভানের শরীরটা ভীষণ আসুস্থ হয়ে পড়ল। খুব মাথাব্যথা করত। একদিন জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছিল সে। এবার আর অপেক্ষা নয়। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হলো তাকে। তার মাথাসহ পুরোটা শরীর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকের ভ্রু কুঁচকে উঠল। বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল তাকে। এরপর চিকিৎসক যা বললেন, তাতে ইভানের পিলে চমকে উঠল। তার মাথায় ক্যান্সার সেল ধরা পড়েছে। হয়তো তার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। এ জীবনকে আর বছরের হিসেবে নয় বরং কিছু মুহূর্তের হিসেবে বাঁচতে হবে তাকে। জন্ম তো মৃত্যুরই নিমিত্তে। মরতে ভয় নেই। কিন্তু চিত্রা? সূর্যের ডুবতে বসা লগ্নে সে এই জীবনে কেন এলো? খানিক বাদে আঁধার ঘনিয়ে এলে একা এত বড় পথ ও পাড়ি দেবে কি করে? ইভানের চোখজোড়া সিক্ত হয়ে এলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। হয়তো আর কিছুই করবার বাকি নাই। এই মুহূর্তে ঘরে ফিরতে হবে। চিত্রার কোলে মাথা রেখেই যদি নিঃশ্বাস ফুরিয়ে যায়, তবুও স্বস্তি। কিন্তু চিত্রাকে সে এসবের কিছুই বলতে চায় না। জীবিত থাকতে ইভান, চিত্রার চোখে জল সহ্য করতে পারবে না।
কিন্তু সব হিসেব এমনটা ছিল না। মা, বন্ধু আর ঈশ্বরের নিকট কোন কথাই গোপন থাকে না। ইভানের অসুস্থতা চিত্রার কাছে গোপন ছিল না। সে সবই জানত। তবু সে ইভানকে কিছুই বলে নি। তাকে দুঃখী করতে চায় নি। সে ঈশ্বরের নিকট দিন রাত্রি প্রার্থনা করত। চিত্রা এমন অভিনয় করত যেন কিছুই সে জানেনা। স্বাভাবিক আচরন করত ইভানের সাথে। আর সময় পেলেই নিবিষ্ট হতো প্রার্থনায় "হে ঈশ্বর পথ দেখাও।"
ধীরে ধীরে ইভানের শারিরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। সকল দোয়া, সকল মানত যখন অর্থহীন জ্ঞান করা হচ্ছিল, তখন এক রাতে চিত্রা সপ্নে একটা সবুজে ঘেরা সুন্দর জায়গা দেখতে পেল। সেখানে প্রায় ভেঙে পড়া একটা স্থাপত্য চোখে পড়ে। পরগাছার আবাস যাকে সবুজ করে তুলেছিল। জায়গাটি একটা উঁচু টিলার মতন। সমতল থেকে ৫১টি সিঁড়ি বেঁয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়। তার মনে হলো কেউ তাকে ডেকে বলছে, প্রিয় কিছু ত্যাগের বিনিময়ে এই স্থানে এসে দোয়া করলে তার একটি দোয়া কবুল হবে। বিষয়টি কাকতালীয়, ঠিক একই সপ্ন ইভানও দেখল। প্রথম রাত্রে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও দ্বিতীয় রাত্রে আবারও একই সপ্ন দেখায় তাদের মনে আশার সঞ্চার হলো। কিন্তু কেউ নিজের সপ্নের ব্যপারে অন্যকে জানালো না। যদিও তারা দুজনেই জানত, তারা কি চাইবে।
পাঁচ
বিকেলে ইভান আর চিত্রা দুজনেই সপ্নে দেখা জায়গাটিতে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। দুজনেরই প্রয়োজন ছিল একে অপরের জন্য একটু বাহানার। ইভানই প্রথম মুখ খুলল। " শরীরটা একটু আড়মোড়া ভাঙতে চাইছে। ভাবছি শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোথাও থেকে কিছুদিন বেড়িয়ে আসি। তুমি যাবে?"
মনতো এমনটাই চাইছিল। তাই মানা করবার কারন ছিল না চিত্রার কাছে। "মন্দ হয়না। তবে যাবে কোথায়?" জানতে চাইল চিত্রা।
"তুমি বল" বলল ইভান।
"চল কোন সমুদ্রের পাড়ে যাই। যেখানে পাহাড় আছে, সেখানে যাই। ঘুরে আসি কোন আরণ্য থেকে। এমন কোথাও, যেখানে নেই কোলাহল, রয়েছে পবিত্রতা। যার চারপাশ সবুজ ছায়াঘেরা, আর তার সামনে প্রবাহমান উত্তাল সমুদ্র। যেখান থেকে আকাশ আরও বেশি নীল দেখা যাবে"।
যেন ইভানের ঠিক মনের কথাটি। তাই সম্মত হলো সেও। এরপর বেড়িয়ে পড়া।
সপ্নে দেখা সেই জায়গাটির খোঁজে। অবশেষে মিলল এমন একটি স্থান যা দেখতে সপ্নে দেখা সেই জায়গাটির মতো। হিমালয়ের পাদদেশে। ভারত মাহাসাগরের খুব কাছে। একটা উচু টিলা। যেখানে অর্ধভঙ্গুর একটা মসজিদ রয়েছে। যার দেয়ালে ফার্ন আর শ্যাওলা সবুজ হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের মতে, মসজিদটি অনেক সময়ের পুরনো। এখানে তেমন কেউ আসেনা। তবে কেউ যদি বিশ্বাস নিয়ে এখানে এসে কিছু প্রার্থনা করে তবে ঈশ্বর কর্তৃক তা মঞ্জুর হয়। ওপরে চড়ার সময় ইভান আর চিত্রা দুজনেই একান্নটি সিঁড়ি গণনা করেছে। তাদের বুঝতে বাকি নেই, যে তারা তাদের গন্তব্ব্যে চলে এসেছে। চিত্রা প্রথমে গিয়ে দুই হাত তুলে ঈশ্বরের নিকট তার দোয়াগুলো নিয়ে অবনত হলো। চিত্রাকে বুঝতে দেবেনা বলে ইভান দুরেই দাড়িয়ে রইল। চিত্রা জানত প্রাণের বিনিময় কেবল প্রাণ হতে পারে। তাই সে ঈশ্বরের কাছে নিজের প্রাণের বিনিময়ে ইভানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে দোয়া করল। দূরে দাঁড়ানো ইভান কি ত্যাগ করবে আর কিই বা চাইবে তা স্থির করতে পারল না। জীবনের অন্তিম লগ্নে নিজের জন্য চাইবার আর কিছুই নেই। তাই সে কেবল এতটুকুই চাইল যেন চিত্রার সকল চাওয়া, সকল দোয়া, সকল মানত ঈশ্বর গ্রাহ্য করেন। আর তার মৃত্যুর পর ঈশ্বর যেন চিত্রাকে চিরসুখী রাখেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পূর্বেই তারা আবার বেড়িয়ে পড়ল। অনেকটা সময় নিরবতার মাঝে কেটে গেল।
"চিত্রা, আমি প্যরিস যেতে চাই। প্রেমের নগরীতে।" আনমনেই বলল ইভান।
"তাহলে চলো। দেরি কিসের?" জবাব দিলো চিত্রা।
ছয়
শেইনের তীরে 'পুঁন দে লা আর্শসিভিশে' ব্রিজ। নিজেদের প্রেমের অমরত্ব চেয়ে এখানে একটি তালা ঝুলিয়ে দিল ইভান আর চিত্রা। যার চাবি দূরে ছুঁড়ে ফেলা হলো শেইনের স্রোতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নাডা নামের এক সার্বিয়ান বালিকা প্রেমে পড়েছিল স্থানীয় এক অফিসার যুবকের। যার নাম ছিল রেলজা। কিছুদিন পর তাদের প্রেম কাহিনী সার্বিয়ার বানজার প্রদেশে খুব আলোচিত হয়। তার কিছুদিন পরই রেলজা যুদ্ধ করতে চলে যায় গ্রীসে। সেখানে গিয়ে রেলজা এক গ্রীক তরুণীর প্রেমে পড়ে এবং নাডার সাথে প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটে। প্রেম বিচ্ছেদের পর নাডা কখনোই এই দুঃখ ভুলতে পারেনি এবং এক সময় এই দুঃখ নিয়েই ধীরে ধীরে তাকে মরে যেতে হয়।
তারপর থেকে সার্বিয়ার বানজার এলাকার মেয়েরা সবসময় চাইতো তাদের প্রেমিককে ধরে রাখতে। তারা চাইতো তাদের প্রেমিক যেন কখনো তাদের ছেড়ে না যায়। তাই তারা একটি তালার মাঝে প্রেমিক-প্রেমিকার দুজনের নামের প্রথম অক্ষর লিখে সেটি ঝুলিয়ে দিত বানজারের এই ব্রিজে যেখানে নাডা এবং রেলজা প্রায় বিকেলেই দেখা করতো।
এবং আজ যেখানে দাড়িয়ে আছে ইভান আর চিত্রা।
সামনে ভালবাসা দিবস। ইভানের ইচ্ছা ঐ দিনেই সে আইফেল টাওয়ারের নিচে চিত্রাকে তার অসুস্থতার ব্যপারে বলবে। আর তাকে বলবে নিজের ভালবাসার কথা। কিন্তু গত কয়েকটি দিন চিত্রার শরীরটা খুব একটা ভাল নেই। সময় যত গড়াতে লাগল সে আরও বেশি অসুস্থ হতে শুরু করল। চিকিৎসায় কিছুই সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই অসুস্থতার ব্যপারে জানত শুধু চিত্রাই। সে জানত যে, তার হাতে সময় আর খুব বেশি নেই। শুধুই এখন ইভানের হাত ধরে একবার আইফেল টাওয়ার যেতে ইচ্ছা হয়। আর কিছু নয়।
অবশেষে এলো সেই দিন। চিত্রা ভীষণ অসুস্থ। সে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ইভান তার পাশে। "ইভান, আমি আইফেল টাওয়ার যাব। আমাকে নিয়ে চলো।" বলল চিত্রা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিত্রার জিদের কাছে হার মানতে হলো ইভানকে। শেইন নদীতে নৌকা ভাসিয়ে তারা এগিয়ে চলল আইফেলের দিকে। সন্ধ্যা তখন আসন্ন। গোধূলি সময়। ইভানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে চিত্রা। নৌকাটা তীরের যত নিকটে আসছিল, কোলাহল ততই বাড়ছিল। এমন সময় আইফেল টাওয়ার আলোকিত হয়ে উঠল। নৌকা তীরে পোঁছে গেল। "চিত্রা? ওঠো। আমরা এসে গেছি।" চিত্রা আর জবাব দিলো না। ,সে আর চোখ খুলল না। এই ঘুম পরপারের। মৃত্যুর পূর্বেই আরও একবার মরে গেল ইভান। ভালবাসা তার দুয়ারে দাড়িয়ে হাত ছেড়ে দিলো।
সাত
ইভান বেঁচে রইল। আজ সে বুঝতে পারল চিত্রা ঐ দিন ঈশ্বরের নিকট কি দোয়া করেছিল। চিত্রা তবে সবই জানত। তার বুকে কতনা কথা জমে ছিল, কত কান্না ছিল যা অশ্রু হয়ে কখনো ঝরেনি। ইভান আমৃত্যু নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। তার বিশ্বাস ছিল চিত্রা ফিরে আসবে একদিন। সে তার জগত ফেলে পরবর্তী সারা জীবন হিমালয়ের পাদদেশের সেই মসজিদটিতে চিত্রাকে ফিরে পাবার জন্য ঈশ্বরের নিকট দোয়া করেছে। চিত্রা ফিরে আসেনি।
অপেক্ষার লম্বা প্রহর পার হয়ে একদিন ইভানের জীবনের সমাপ্তি হলো। তার আত্মা শরীরকে বিদায় দিয়ে এমন এক জগতে গিয়ে পৌঁছল যেখানে এর আগে কেউ আসেনি। চারিদিকে পাহাড়ি সবুজ। নীল সমুদ্র। অপরুপ ঝর্ণাধারা, আর রংবেরং ফুলের বাগান। খুব সুন্দর একটা প্রজাপতি তার নজর কেড়ে নিলো। রঙের ডানা ঝাপটে সেটি উড়ে চলল। ইভান তাকে অনুসরণ করে চলল। ঝরনার পানিতে পা ডুবিয়ে একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখল ইভান। প্রজাপতিটি গিয়ে মেয়েটির মেঘ কালো চুলের ওপর বসলো। মেয়েটির পরিচয় জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছিল ইভানের। সে ধিরপায়ে এগিয়ে গেল। আর মেয়েটির কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটি ফিরে তাকাতেই সেই প্রথম সাক্ষাতের মতন সম্মোহিত হয়ে পড়ল ইভান। কারন এই মেয়েটিই তার চিত্রা। চিত্রার চুলের ভাঁজে একখানা চিঠির মতন কিছু দেখতে পেল ইভান। তাতে লেখা রয়েছে, " তোমার আমানত তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া হলো। তোমাদের ভালবাসার পরীক্ষায় তোমরা উত্তীর্ণ। এখানে আর কোন বাধা নেই। তোমরা এখানে থাকবে চিরকাল। তোমাদের প্রেম আর কখনো কমবে না, তোমাদের প্রেমে আর কখনো ছেদ পড়বে না।"
" কি লেখা এতে?" জানতে চাইল চিত্রা।
" তুমি। তোমার নাম। শুধু তুমি।" এটি ছিল ইভানের জবাব। তারপর এক গভীর আলিঙ্গনে মিশে গেল দুজনে। তাদের সময় এখানেই থেমে রইবে হাজার বছর। তাদের প্রেম চির নতুন আজও। পৃথিবীতে প্রতিটি জোড়া ইভান-চিত্রার প্রেমের প্রতিনিধি। ইভান আর চিত্রা স্বর্গ থেকে তাদের দেখে আর দোয়া করে তাদের জন্য।
" হে ঈশ্বর, সার্থক হোক পৃথিবীর প্রতিটি ভালবাসা"
No comments:
Post a Comment