প্রিয় আরাধ্য- শাহরিয়ার আহমেদ |
বসন্তের স্বর্ণোজ্জ্বল দিনের প্রথম প্রহর। চারিপাশে চিকচিকে রোদের লহর। পরিষ্কার নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা। দূরে দাঁড়ানো গাছগুলো তাদের পুরনো পত্রের বিনিময়ে পেয়েছে নতুন, হয়ে উঠেছে সবুজ- যৌবনা। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মাঠের কচি ঘাসগুলো আর বাগিচার আনাজ। প্রকৃতির এ যেন নববধুর সাজ। আঙিনা ঘ্রাণময় করে তুলেছে রঙ-বেরঙের নাম জানা কিংবা না জানা হাজারো ফুল। তাদেরকে ঘিরে নিজনিজ বসন্ত উদযাপনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে মৌমাছি আর প্রজাপতিকূল। গাছের আবডালে বসে চিরচেনা অথচ চিরনতুন সুরে গান গাইছে কোকিল। শোনা যায় আরও কতনা পাখির কূজন, এ যেন পল্লীকবির কাব্যের গুঞ্জন।
জানালার বাহিরের পৃথিবীটা কতইনা মনোমুগ্ধকর, ভাবছিল অরু।
অরু? –ডাকলেন শিক্ষিকা।
তরুণী মনের প্রথম কল্পনাতে এ যেন রাবণের হানা। মোহভঙ্গ হলো অরু। ‘জী ম্যাডাম?’ সন্ত্রস্ত কণ্ঠে অরুর জবাব।
‘এই মাত্র যে কবিতাটি পড়া হলো তার ভাবার্থ বলো’।
অরু যেন আকাশ থেকে পড়ল। ক্লাসে নিজের উপস্থিতি, যেন তার নিজেরই বিশ্বাস হতে চাইল না। ‘কবিতাটি শুনতে পাইনি ম্যাডাম’। অরুর সহজ আত্মসমর্পণ।
এমন জবাবের পর পুরো ক্লাস হেসে উঠল। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ম্যাডাম নিজে শুরু করলেন। ঘড়িতে কতক্ষণ কে জানে, অরুর মনে হলো যেন হাজার বছর ধরে চলল সেই বক্তৃতা। তিরস্কারের ভাষাগুলো অবশ্য পূর্ব থেকেই মুখস্ত ছিল অরুর। কারণ এমন ঘটনা আজই প্রথম নয়। তিরস্কার সমৃদ্ধ শিক্ষার এটি একটি ভাল দিক; গুরুত্ব সহকারে নিলে মাথায় ব্যথা হয়ে চড়ে। আর গুরুত্ব না দিলে? এক কান দিয়ে ঢুকে, অপরটি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অরু দ্বিতীয়টিকে পালন করে। ফলে যোগফল সদাই শুন্য।
আজকের মতন রেহাই হয় অরুর, বেজে ওঠে ছুটির ঘণ্টা। সকলে ক্লাস ত্যাগ করে। সময় পেলেই স্কুলের করিডোরের শেষ প্রান্তে একাকি বসে থাকতে পছন্দ করত অরু। আজও সেখানেই বসেছে সে। আপন মনে আবার কত কি ভেবে চলা। ভাবনার রাজ্যেই তো মানুষ কেবল একাকি স্বাধীন, নিরাপদ। যে রাজ্যের পথ বড় দীর্ঘ। যে রাজ্যে সময় বড্ড লাগামহীন। তেমনই এক রাজ্যে ছুটে বেড়াতে থাকে ছোট্ট অরু। আজ সে তার বন্ধুর কাছ থেকে অনেকগুলো শাপলা ফুল নিয়ে এসেছে। খেলতে খেলতে সুন্দর একখানা রাজপ্রাদের সামনে এসে পৌঁছয় সে। রাজকন্যা হবার স্বপ্ন দেখত অরু। তাই সে প্রাসাদের দিকে ধিরপায়ে এগিয়ে যায়। প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করে। সবকিছু কত গোছালো, কত সুন্দর। গাছে কত ফুল-ফল, পাখি। টেবিলে সাজানো নানা প্রকারের সুস্বাদু খাবার। অরু ক্ষুধা মিটিয়ে খাবার খায়। তারপর হারিয়ে যায় ঘুমের দেশে। ঘুম ভেঙ্গে সে দেখতে পায় দুটো দৈত্যকে। অরুকে কে খাবে তাই নিয়ে তারা ঝগড়া করছে। অরু ভয় পায়। পালিয়ে যেতে চায়, চিৎকার করে কাঁদে, দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তাক্ত হয়, প্রার্থনা করে, তবু মুক্তি মেলেনা কিছুতে। সে বুঝতে পারে, দৈত্যগুলো তাকে অধিকার করে নিয়েছে। পালাবার তাই আর পথ বুঝি নেই। সে মানিয়ে নিতে চায়। তবু পারে না। দৈত্যগুলো অরুকে খায় না। ওরা কেবলই ঝগড়া করে, প্রাসাদের সুন্দর সব তৈজসপত্র ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। ভয় হয় অরুর। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়। বড় হয়ে যায় অরু। এই দৈত্য দুটি যে তার মা-বাবা তা সে বুঝতে পারে। সে খুব কষ্ট পায় ওদের জন্য। নীরবতা বাঁধ ভেঙ্গে দিতে চায়, আবার ভাঙ্গে না। অল্প দিনেই একটা সুরাহা হয়। ওরা বিচ্ছেদ গ্রহণ করে। নিজেরা আবার নতুন সংসার বাঁধে। এরই ফাঁকে একদিন পালিয়ে যায় অরু। আজ আর দৈত্যের ভয় নেই। তাই নেই, রাজকন্যা হবার অনুভূতি। অরু আর কখনো সেই দৈত্যদেরকে দেখতে চায়না। সে এখন তার নিজের জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী তৈরি করতে চায়। অরু লেখিকা হতে চায়। কল্পনার সব রঙ ঢেলে দিতে চায় কাগজে। একদিন সত্যি সত্যি রাজকন্যা হয়ে উঠতে চায় সে। খুঁজে পেতে চায় বন্ধুর দেয়া হারিয়ে যাওয়া সেই শাপলা ফুলগুলো।
চলবে...
No comments:
Post a Comment